ভারত ও চিনের কাছে লাদাখের গুরুত্ব জটিল ও ঐতিহাসিক। তারই জেরে এই এলাকা জম্মু কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তিব্বত দখলের পর চিনের লাদাখের প্রতি আগ্রহ বাড়ে।
লাদাখের জম্মু-কাশ্মীরভুক্তি
১৮৩৪ সালে ডোগরা আক্রমণের আগে পর্যন্ত লাদাখ ছিল স্বাধীন হিমালয় রাষ্ট্র, যেমনটা ছিল ভূটান ও সিকিম। ঐতিহাসিক এ সাংস্কৃতিকভাবে এই রাজ্য তিব্বতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ছিল। লাদাখ ও তিব্বত ভাষাগত ও ধর্মীয়ভাবে যুক্ত তো ছিলই, রাজনৈতিক ভাবেও তাদের ছিল একই ইতিহাস।
ঐতিহাসিক জন ব্রে তাঁর গবেষণাপত্র Ladakhi history and Indian nationhood-এ লিখেছেন “লাদাখ ছিল তিব্বত সাম্রাজ্যের অংশ যা ৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা লাংদর্মার মৃত্যুর পর ভেঙে যায়। এর পর এ রাজ্য হয়ে ওঠে স্বাধীন, যদিও ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে এর সীমানাও পাল্টেছে, এবং বিভিন্ন সময়ে তা বর্তমান পশ্চিম তিব্বতের অংশ হয়েছে।
আর্থিকভাবে এই এলাকা গুরুত্বপূর্ণ কারণ মধ্য এশিয়া ও কাশ্মীরের মাঝে এটিই ছিল গুদামস্থল।” ব্রে লিখছেন, “তিব্বতের পশম শাল উল লাদাখ হয়ে কাশ্মীর যেত। একই সঙ্গে কারাকোরম পাস হয়ে ইয়ারকন্ড ও কাশনগরের মধ্যে দিয়ে চিনা তুর্কিস্তান পর্যন্ত পথ বাণিজ্যের রাস্তা হিসেবে বেড়ে উঠেছিল।”
আরও পড়ুন, সীমান্তে ভারত-চিন সংঘর্ষ: পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, এর পর কী?
১৮১৯ সালে শিখরা কাশ্মীরের দখল নেওয়ার পর রাজা রণজিৎ সিং লাদাখের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু জম্মুর শিখদের ডোগরা জায়গিরদার গুলাব সিং লাদাখকে জম্মু কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
ব্রিটেনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ভারতে নিজেদের পা শক্ত করে ফেললেও লাদাখে প্রথম দিকে তাদের আগ্রহ ছিল না। তবে এলাকায় ডোগরা আক্রমণ নিয়ে তাদের উৎসাহ ছিল, তাদের আশা ছিল এর ফলে তিব্বতের ব্যবসার বড় অংশ তাদের হাতে আসবে।
১৮৩৪ সালে গুলাব সিং তাঁর সবচেয়ে সমর্থ সেনাপতি জারওয়ার সিং কালুরিয়াকে ৪০০০ সেনার সঙ্গে ওই এলাকা দখল করতে পাঠান।
প্রথমে লাদাখিরা হতচকিত হয়ে যাওয়ায় কোনও প্রতিরোধই গড়তে পারেনি, কিন্তু ১৮৩৪ সালের ১৬ অগাস্ট ডোগরারা হারিয়ে দেয় ৫০০০ সেনাদলকে, যার নেতৃ্ত্বে ছিলেন ভুটিয়া নেতা মঙ্গল। এরপর লাদাখ চলে আসে ডোগরাদের অধীনে। ১৮৪১ সালের মে মাসে চিনের কুইং সাম্রাজ্যের অধীন তিব্বত লাদাখ আক্রমণ করে, তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল এই এলাকাকে চিনের সাম্রাজ্যে নিয়ে আসা। এর জেরে শুরু হয় চিন-শিখ যুদ্ধ। চিন-তিব্বত সেনা পরাজিত হয় এবং চুসুল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে বলা ছিল কোনও দেশই অন্যের সীমানায় পা দেবে না।
১৮৪৫-৪৬ সালে প্রথম ইংরেজ-শিখ যুদ্ধের পর লাদাখ সহ জম্মুকাশ্মীর ইংরেজদের হাতে চলে যায়।
গবেষক তথা আম্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অভিজ্ঞান রেজ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, “জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের পরিকলাপনা ছিল ব্রিটিশদের, তারা রাশিয়ানদের সঙ্গে মোলাকাতের জন্য একটা বাফার জোন বানাতে চাইছিল। একই সঙ্গে তারা লাদাখের আলাদা অস্তিত্বও রাখতে চায়নি, কিন্তু এই এলাকা তিব্বত ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে থাকায় সে পরিকল্পনা কার্যকর হয়নি।
আরও পড়ুন, ভারত-চিন সংঘর্ষ: ফিরে দেখা ১৯৬৭ সালের গুলির লড়াই
একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, সে সময়ে মানুষের কাছে দেশের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। ফলে জম্মু কাশ্মীরকে মানচিত্রে দেখানোর সময়ে ব্রিটিশরা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলে থাকতে পারে।”
মানচিত্র নিয়ে ব্রিটিশদের ধারাই বহন করে গিয়েছে ভারত। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তাঁর বই ইন্ডিয়া আফটার গান্ধীতে বলেছেন, “ভারতীয়েরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই দাবি করে এসেছে এটাই সীমানা, তাদের পক্ষে ছিল চুক্তি এবং ঐতিহ্য, অন্যদিকে চিনারা দাবি করেছে এ এলাকা কখনওই নির্ধারিত হয়নি। দুই সরকারের তরফেই এই দাবির পিছনে ছিল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার, ভারতের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, চিনের ক্ষেত্রে তিব্বতের উপর চৈনিক সাম্রাজ্যবাদ।”
১৯৫০ সালে তিব্বত দখলের পর চিনের লাদাখে আগ্রহ
১৯৫০ সালে গণ প্রজাতন্ত্রী চিন তিব্বত দখল করার পর তাদের লাদাখ নিয়ে নতুন করে আগ্রহ জন্মায়, বিশেষ করে দলাই লামা পালিয়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবার পর লাসায় ১৯৫৯ সালে যে তিব্বতি বিদ্রোহ হয়েছিল তার পর।
ফিশার ও রোজ লিখছেন, “তিব্বতি বিদ্রোহ দমনের জন্য এবং একই সঙ্গে তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা জন্য চিনারা এমন পদ্ধতির আশ্রয় নেয় যা ভারত ও চিনের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষপরিস্থিতি তৈরি করে।”
১৯৫৬-৫৭ সালে চিন লাদাখের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তা তৈরি করে তা তিব্বতের উপর দখল কায়েম রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল। তাঁরা বলছেন, “এরকম একটা সাপ্লাই রুট ছাড়া পূর্ব তিব্বতের খাম্পা বিদ্রোহ ভয়ংকর জায়গায় পৌঁছতে পারত।”
আরও পড়ুন, চিনের পেশিপ্রদর্শনের কারণ কী?
এই রাস্তা তৈরি নেহরু সরকারকেও চিন্তায় ফেলেছিল। রেজ বলেন, “নেহরু আশা করেছিলেন তিব্বত চিনের অধিকারে থাকা সত্ত্বেও কিছুটা স্বায়ত্তশাসন পাবে। অপেক্ষাকৃত স্বাধীন তিব্বত চিন ও ভারতের মধ্যে বাফার হিসেবে কাজ করতে পারত। একবার রাস্তা তৈরি শুরু হওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন মূল চিনের সঙ্গে তিব্বতের সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।”
কূটনৈতিক দৌত্য ব্যর্থ হয়, ১৯৬২ সালের যুদ্ধ হয়। লাদাখে ফের কেন সংঘর্ষ পরিস্থিতি তৈরি হল, সে নিয়ে রেজ বলছেন, “এর দুটি স্তর রয়েছে। প্রথমত ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই এলাকায় ভারতের পরিকাঠামো ছিল নামমাত্র। ২০১৩ থেকে ভারত পরিকাঠামোয় জোর দিতে শুরু করে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে তা ভারতের অন্যতম প্রতিরক্ষাগত অগ্রাধিকারের এলাকা হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় স্তর হল ২০১৯ সালের ৫ অগাস্ট জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সরিয়ে নেওয়া ও একটি রাজ্য থেকে তাকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নামিয়ে আনার ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত। চিনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে. তারা ভেবেছে লাদাখকে যদি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয় তাহলে গোটা রাজ্যের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। একই সঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে আকসাই চিনের অংশ শিনজিয়াং চিনের পক্ষে তাদের আভ্যন্তরীণ কারণেও অত্যন্ত জরুরি।”