নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে সারা দেশ বিক্ষোভে উত্তাল হবার পর, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একটি বিষয়ে অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যেসব বিদেশিরা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের খুঁজে বের করে ভারত ছাড়ার নোটিস ধরানো হচ্ছে।
সাম্প্রতিককম ঘটনা ঘটেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কামিল সিদচিনস্কির ক্ষেত্রে। কলকাতা শহরে ক্যা বিরোধী মিছিলে অংশগ্রহণ করার জন্য তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। তার কয়েকদিন আগেই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি ছাত্রী আফসারা আমিকা মিমকে সরকারবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগে দেশ ছাড়তে বলা হয়েছে, তবে তাঁর ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে কার্যকলাপের কথা বলা হয়নি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ক্যাবিরোধী বিক্ষোভের ছবি শেয়ার করেছিলেন বলে অভিযোগ। গত বছর ডিসেম্বর মাসে আইআইটি মাদ্রাজের জার্মান ছাত্র জেকব লিন্ডেথালকে তাঁর দেশে ফেরত পাঠানো হয়। একই কারণে নরওয়ের পর্যটক জ্যান মেতে জোহানসনকেও কোচির ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
প্রাসঙ্গিক, সরকারের সমালোচনা মানেই দেশদ্রোহিতা নয়: আইন কমিশন
ভারতে সরকার বিরোধী কার্যকলাপের আইন কী? ভারতীয়ের ক্ষেত্রে ও ভারতীয় ভিসা ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে কি নিয়ম একই?
ভারতের ভিসা গাইডলাইনে সরকারবিরোধী কার্যকলাপ সম্পর্কে কী বলা রয়েছে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের যে ভিসা গাইডলাইন রয়েছে, সে অনুসারে বিদেশিদের স্পষ্টভাষায় এ দেশে আসার কারণ বর্ণনা করতে হয় ভিসার আবেদনেই। তবে যে কোনও বিদেশি (পাকিস্তানি বাদে) যে কোনও ধরনের ভিসায় ভারতে এলে তিনি ট্যুরিস্ট ভিসায় যেসব কার্যকলাপ রয়েছে তার সবেরই অনুমোদন পান।
সরকার বিরোধী কার্যকলাপের কোনও বিধির কথা কিন্তু এই ভিসায় লেখা উল্লিখিত নেই।
পড়ুন, রাষ্ট্র এবং দেশদ্রোহিতা- জয়প্রকাশ নারায়ণ, ফার্নানডেজ থেকে বিদারের শিশুরা, শরজিল ইমাম
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী সপ্তক সান্যালের কথায় ফরেনার্স অ্যাক্ট বা ভিসা আইনে এ ধরনের কোনও বিধি নেই বলে সরকারের উচিত সরকার বিরোধী কার্যকলাপকে সংজ্ঞায়িত করে একটি বিধি প্রণয়ণ করা। তিনি বলেন, "ভিসা আইন অন্য কোনও আইনের তুলনায় খাটো নয়, ফলে নানরকম ব্যাখ্যা আসবেই- যার অর্থ কোনও একটি আদালত এরকম নির্দেশ দিতেই পারে যে ভারতীয় নাগরিকের পক্ষে যা সরকারবিরোধী, বিদেশিদের ক্ষেত্রেও তাইই সরকারবিরোধী। ফলে কাকে সরকারবিরোধী কার্যকলাপ বলা হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা উচিত।"
ভারতীয়দের ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী কার্যকলাপ বলতে কী বোঝায়?
আইনজীবীরা বলছেন, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ এ ধারায় (দেশদ্রোহিতা) যেগুলি শাস্তিযোগ্য, সেগুলিই সরকার বিরোধী কার্যকলাপ। ১২৪ এ ধারায় বলা হয়েছে, "লিখিত, কথিত, ইঙ্গিতের মাধ্যমে বা কোনও রকম চিত্র বর্ণনার মাধ্যমে বা অন্য কোনও ভাবে যদি কেউ ভারতের আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি বীতরাগ উৎপাদনের চেষ্টা করেন বা ঘৃণা অথবা মানহানির চেষ্টা করেন, তাহলে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে, একই সঙ্গে জরিমানা হতে হতে পারে বা তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে।"
ভারতীয় ভিসা সহ বিদেশিদের কি বিক্ষোভের অধিকার নেই?
ভারতীয় সংবিধানের ১৯ (১) (এ) ধারায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে বিক্ষোভের অধিকারও রয়েছে। ১৯ (বি) অনুচ্ছেদে দেশের নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিরস্ত্রভাবে নাগরিকদের জমায়েত হবার অধিকার দেওয়া রয়েছে। আফসারার আইনজীবী শামিম আহমেদ বলেন ভারতের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে যে কোনও মানুষকে আইনের চোকে সমদৃষ্টিতে দেখার কথা বলা বয়েছে। বিদেশিরাও শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাতে পারেন। তিনি ভারতীয় সংবিধানের ২১ নং ধারার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে বলা রয়েছে, আইনি বিধি ব্যতিরেকে কারও জীবন বা ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। শামিমের কথায়, বিক্ষোভ দেখানো ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।
পড়তে ভুলবেন না, দু’বছরে দ্বিগুণ দেশদ্রোহিতার মামলা, শীর্ষে ঝাড়খণ্ড
দিল্লির আইনজীবী শিল্পা দাস বলেন, "শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে শামিল হওয়া বেআইনি নয় এবং তা যদি ভারত সরকারের বিরুদ্ধে হয়, সেরকম বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করা দোষের কিছু নয়।"
কোনও বিদেশিকে তাঁর কাজের খতিয়ান না দেখিয়েই কি ভারত ছাড়তে বলা চলে ?
২০১৯ সালের একটি মামলার উল্লেখ করলেন সপ্তক সান্যাল। সেক্ষেত্রে একজন পাক মহিলা নাগরিককে কোনও কারণ না দেখিয়ে দেশ ছাড়তে বলা হয়। "দিল্লি হাইকোর্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সে নির্দেশ খারিজ করে গিয়ে বলে কোনও কারণ না দেখিয়ে এ ধরনের নির্দেশ দেবার অধিকার সরকারের নেই। যদিও মৌলিক অধিকার কেবলমাত্র দেশের নাগরিকদের জন্যই বলবৎ, কিন্তু সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, আদালতের নির্দেশে তা বিদেশিদের জন্যও লাগু হতে পারে। ফলে, বিদেশিদের দেশ ছাড়তে বলার আগে সরকারের উচিত কোন কাজ সরকারবিরোধী তা নির্দিষ্ট করা।"
তিনি বলেন, "ভিসা বাতিল করার পদ্ধতি মেনে ও স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের সূত্র মেনে হওয়া উচিত। অন্য পক্ষকে জানানো স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের অংশ। ফলে যাঁর ভিসা বাতিল হচ্ছে তাঁকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া উচিত।"