স্প্যানিশ ফ্লু: শতবর্ষে হঠাৎ প্রাসঙ্গিক ভারতের আরেক মহামারী
একশো বছর আগে প্রকৃতির এই নিধনযজ্ঞের কেন্দ্রে ছিল ভারতবর্ষ, প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ থেকে ২ কোটি মানুষ। কীভাবে নিয়ন্ত্রণে এসেছিল মহামারী? তার থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি আমরা?
একশো বছর আগে প্রকৃতির এই নিধনযজ্ঞের কেন্দ্রে ছিল ভারতবর্ষ, প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ থেকে ২ কোটি মানুষ। কীভাবে নিয়ন্ত্রণে এসেছিল মহামারী? তার থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি আমরা?
১৯১৮ সালের মহামারীর সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস প্রদেশে আপৎকালীন হাসপাতাল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
বিশ্বব্যাপী মহামারী ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই COVID-19'এর তুলনা শুরু হয়েছে ১৯১৮-১৯ সালের 'স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা' মহামারীর সঙ্গে। আজ থেকে ঠিক এক শতক আগের এই মহামারী মানবজাতির সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম, যা পৃথিবী জুড়ে কেড়ে নিয়েছিল ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন (২ থেকে ৫ কোটি) মানুষের প্রাণ।
Advertisment
স্প্যানিশ ফ্লু: মহামারীর গতিপ্রকৃতি
একশো বছর আগে প্রকৃতির এই নিধনযজ্ঞের কেন্দ্রে ছিল ভারতবর্ষ, প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ থেকে ২ কোটি মানুষ। দুটি ধাপে ভারতকে গ্রাস করে স্প্যানিশ ফ্লু - প্রথম ধাপে এর প্রভাব ছিল অপেক্ষাকৃত মৃদু, কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে সারা দেশে আছড়ে পড়ে মহামারী, ১৯১৮ সালের অন্তিম ভাগে। মনে করা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরতে থাকা সৈনিকদের হাত ধরেই ভারতে প্রবেশ করে স্প্যানিশ ফ্লু।
এই মহামারীর তীব্রতা, বিস্তারের গতি, এবং স্থায়িত্ব অনুমান করতে তৎকালীন ন'টি প্রদেশের ২১৩টি জেলায় সাপ্তাহিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান ভিত্তিক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। সেই গবেষণাপত্রের লেখকরা বলছেন, তাঁদের অনুমানের উদ্দেশ্য হলো স্থান- এবং সময়-ভিত্তিক তথ্য ব্যবহার করে ১৯১৮'র মহামারীর বিস্তার, মৃত্যুর হার, এবং বিবর্তনের চরিত্র নির্ধারণ করা (‘The Evolution of Pandemic Influenza: Evidence from India, 1918-19’, by Siddharth Chandra and Eva Kassens-Noor: BMC Infectious Diseases, 4, 510 (2014))
১৯১৮ সালে ভারতের তিনটি অঞ্চলে স্প্যানিশ ফ্লু-এর প্রাদুর্ভাব
গবেষণায় যে চারটি মূল তথ্য প্রকাশ পায়, তা হলো, যত দিন যায়, (ক) তত কমে আসে মহামারীর তীব্রতা; (খ) মহামারীর গতি হ্রাস পায়, অর্থাৎ রোগের আবির্ভাব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অতিবাহিত সময় বৃদ্ধি পায়; (গ) তবে মহামারীর মেয়াদ বৃদ্ধি পায়; (ঘ) ভারতের পূর্বভাগে মহামারী সবচেয়ে শেষে এসে পৌঁছয়।
কেন ধীরে ধীরে কমে যায় মহামারীর প্রকোপ?
কীভাবে ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দাপিয়ে বেড়ানোর পর শান্ত হয়ে আসে স্প্যানিশ ফ্লু? এর তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান গবেষণাপত্রের সহ-লেখক প্রফেসর সিদ্ধার্থ চন্দ্র, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের অধিকর্তা।
"(১) এই মারণ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ছড়াতে থাকে হয় লোকমুখে, নাহয় সরকারের তৎপরতায়, সুতরাং কলকাতায় যতদিনে ইনফ্লুয়েঞ্জা এসে হানা দেয়, ততদিনে 'সামাজিক দূরত্ব' বা 'social distancing' এবং অন্যান্য প্রতিষেধক ব্যবস্থা নিতে শুরু করে দিয়েছেন শহরবাসী, যা রোগের আকস্মিক আবির্ভাবের ফলে করতে পারেন নি তৎকালীন মাদ্রাস বা বম্বের বাসিন্দারা।"
"(২) ভারত জুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে করতে বিবর্তন ঘটে এই ভাইরাসের। একটি তত্ত্ব বলে যে, ভাইরাস যত ছড়ায়, তত কমে আসে তাদের মধ্যে মারাত্মক প্রজাতিগুলির টিকে থাকার এবং বংশবৃদ্ধি করার সম্ভাবনা, যেহেতু যে বাহক শরীরে তারা অধিষ্ঠিত, তা ছেড়ে বেরোনোর আগেই মৃত্যু হয় সেই বাহকের। এর ফলে পাল্টে যায় ভাইরাসের গঠন, এবং কমতে থাকে তার তীব্রতা।"
"(৩) ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আবহাওয়ার তারতম্য। অধিকাংশ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস উষ্ণ এবং আর্দ্র পরিবেশে ততটা স্বচ্ছন্দ নয় যতটা শীতলতর, শুষ্ক পরিবেশে।"
১৯১৮ সালের মহামারীর সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যান্ড মিউনিসিপাল অডিটোরিয়াম পরিণত হয় হাসপাতালে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
তবে প্রফেসর চন্দ্র এও যোগ করছেন, "আমরা এখনও নিশ্চিতভাবে জানি না, এই তিনটি কারণের কোনটি ভারতে (স্প্যানিশ ফ্লু) মহামারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।"
তৎকালীন এক স্যানিটারি কমিশনার "অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বৃষ্টি" এবং রোগের তীব্রতার মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করেন। তাঁর রিপোর্টে একাধিকবার তিনি উল্লেখ করেন, দেশের উপকূলবর্তী এলাকায় কম মৃত্যুর হার চোখে পড়ার মতো, যা "আর্দ্রতা তত্ত্ব"কেই সমর্থন করে।
মহামারীর শতবর্ষের প্রাক্কালে এই গবেষণার উদ্দেশ্য, ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রাদুর্ভাব ঘটলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ কৌশল অবলম্বনে সাহায্য করা। গবেষণাপত্রে যা বলা হয়েছে, তার সারমর্ম দাঁড়ায়, "সারা ভারতে ছড়িয়ে যাওয়া মহামারীর তীব্রতা হ্রাস পাওয়া এবং তার মেয়াদ বৃদ্ধি পাওয়ার... মহামারী নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে তাৎপর্য রয়েছে। ভবিষ্যতের কোনও মহামারীর ক্ষেত্রে প্রতিষেধক পদক্ষেপ নেওয়ার সময় তার পরিবর্তনশীল চরিত্রের কথা মাথায় রাখতে হবে।"
বর্তমান প্রেক্ষিতে যা শিক্ষণীয়
ভারতে ফের একবার দেখা দিয়েছে বিশ্বব্যাপী আরও এক মহামারী। এক্ষেত্রে দ্রুত প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। গবেষণাপত্রের শেষে বলা হয়েছে, "ভারতে ১৯১৮-র মহামারীর মতো প্রেক্ষাপট তৈরি হলে, দেশের যে অঞ্চল দিয়ে মারণ জীবাণুর প্রবেশ ঘটেছে, তার সংলগ্ন এলাকাগুলিকে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে, যার ফলে স্বল্পমেয়াদী অথচ তীব্র প্রকোপের মোকাবিলা করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।"
আরও বলা হয়েছে, "অকুস্থল থেকে দূরে অবস্থিত এলাকায় প্রস্তুত হওয়ার আরও সময় পাওয়া যাবে, এবং রোগের তীব্রতাও কমবে, তবে মহামারীর মেয়াদ বৃদ্ধি পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপও হতে হবে দীর্ঘকালীন।"
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইস শহরে ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর সময় কর্মরত রেড ক্রস মোটর কর্পস। ছবি: ন্ন্যাশনাল আর্কাইভস
স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী থেকে আরও একটি জরুরি শিক্ষা পেতে পারে ভারত। প্রফেসর চন্দ্র বলছেন, "আমরা দেখেছি, রোগ যত ছড়িয়েছে, ততই মৃত্যুর হার কমেছে, এবং তা যদি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ফলেই সত্যিই হয়ে থাকে, তবে আমাদের পক্ষে তা অত্যন্ত বেশি রকমের শিক্ষণীয়। পরিচ্ছন্নতা এবং সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হওয়া প্রয়োজন।"
তাঁর কথায়, এই মানসিকতা তৈরি করার সহজতম উপায় হলো "আপনার চারপাশে সকলেই আক্রান্ত, এমনটা ভেবে নেওয়া"। সংক্রমণের হার কমিয়ে আনতে পারলে তবেই নিশ্চিত করা যাবে যে দেশের সমস্ত ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট চাপের মুখে অচল হয়ে পড়বে না - যা ইতালির উত্তরাঞ্চলে প্রাথমিকভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে করা হয় নি বলেই ভেঙে পড়ার উপক্রম সেদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার।
আমাদের নিউজলেটার সদস্যতা!
একচেটিয়া অফার এবং সর্বশেষ খবর পেতে প্রথম হন