কোভিড-১৯-এর জন্য সারা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম কঠোর লকডাউন পালিত হয়েছে ভারতে। এর জেরে ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ভারতের আর্থিক কাজকর্ম প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ থেকেছে, মে মাস জুড়ে ধাপে ধাপে আংশিক ভাবে এই বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে। লকডাউনের নিশ্চিত ফল হিসেবে কর্মহীনতা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CMIE)-র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত, লকডাউনের পূর্ববর্তী এক বছরে দেশে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল ৪০ কোটির কিছু বেশি (৪০৩৭৭০৫৬৬)। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এই সংখ্যা নেমে এসেছে ২৮ কোটির কিছু বেশি (২৮২২০৩৮০৪)-তে। এই কর্মহ্রাসের পরিমাণ ৩০ শতাংশ।
মাস্ক ব্যবহার নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত বদল- গোটা পৃথিবীতে কী নিয়ম
মনে করা হচ্ছে সারা পৃথিবীতেই কোভিড অতিমারীর জেরে কাজ হারানোর আশঙ্কা পুরুষের থেকে মহিলাদের মধ্যে বেশি। সিটিব্যাঙ্কের এক রিসার্চ নোটের হিসেব অনুসারে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২২০ মিলিয়ন মহিলা কাজ যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি এমন ক্ষেত্রে কর্মরত। বেশি কাজ যাওয়ার সম্ভাবনা এমন ক্ষেত্রে কর্মরত ৪৪ মিলিয়নের মধ্যে ৩১ মিলিয়ন মহিলার ও ১৩ মিলিয়ন পুরুষের কাজ যেতে পারে।
ভারতের ক্ষেত্রে এ রকম একটা ছবির দিকে তাকানো যাক। ২০০৪-০৫ থেকে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের তারতম্য কমে এসেছে, একই সময়কালে কর্মশক্তিতে যোগদানের ক্ষেত্রে তারতম্য বেড়েছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে কর্মশক্তিতে যোগদান গত কয়েক দশক ধরেই কম, তবে গত ১৫ বছরে তা আরও কমেছে।
কাজে অংশগ্রহণ ও নিয়োগের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত তারতম্য কি লকডাউন ও রিসেশনের জন্য আরও বাড়বে? যেসব মহিলারা ইতিমধ্যেই কর্মরত তাঁদের কাজ হারানোর আশঙ্কা কি পুরুষদের চেয়ে বেশি? আর্থসামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা জাতিভুক্তরা কি উঁচু জাতির চেয়ে বেশি আশঙ্কার মধ্যে?
আরও সাধারণভাবে বলতে গেলে, অতিমারীর কারণে যে লকডাউন, তা কি সামাজিক পরিচিতি নিরপেক্ষভাবে সকলের উপর প্রভাব ফেলবে, নাকি যেসব গোষ্ঠী পিছিয়ে থাকা, তাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন?
***
সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে আমি প্রথম কর্মহানির ক্ষেত্রে লিঙ্গ ও জাতিগত দিকটি নিয়ে আলোচনা করেছি। লকডাউনের আগের এক বছরে মোট নিয়োগে পুরুষের সংখ্যা মহিলাদের চেয়ে বেশি ছিল এবং লকডাউনের প্রথম মাসে কর্মহানির ঘটনা মহিলাদের চেয়ে পুরুষের মধ্যে বেশি। কিন্তু পূর্বস্থ ফারাকের কথা মাথায় রাখলে আমরা একটা তুলনামূলক কর্মহানির হিসেব পাব, এপ্রিলে কর্মরত মানুষের সংখ্যার সঙ্গে গত বছরের গড়ের তুলনা করা সম্ভব হবে।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধিত- এর ফলে কী হবে
বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে করা হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে লকডাউনের শুরুর দিকে যাঁদের কর্মহানি ঘটেছে তার মধ্যে লিঙ্গ ও জাতিগত অসাম্য রয়েছে- মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে বেশি ভুক্তভোগী (শহুরে মহিলাদের চেয়ে গ্রামীণ মহিলাদের সংখ্যা বেশি) এবং দলিত (তফশিলি জাতি)রা উচ্চবর্ণের চেয়ে বেশি ভুক্তভোগী, বিশেষ করে গ্রামীণ দলিতরা। গ্রামীণ মহিলাদের কর্মহানি সবচেয়ে বেশি।
আরও সুনির্দিষ্ট করে লকডাউনের দিকে চোখ রাখা যাক। এপ্রিল ২০২০-র (লকডাউন পরবর্তী সময়) ৩৭০০০-এর কিছু বেশি পরিবারের নমুনা নিয়ে, ২০১৯ সালের নভেম্বর ডিসেম্বরের তাদের এমপ্লয়মেন্ট স্ট্যাটাসের সঙ্গে তুলনা করেছি।
এই তুলনার মাধ্যমে কর্মহানির পরিমাণ নিখুঁতভাবে আঁচ করা গিয়েছে, একই সঙ্গে কর্মহানির কারণ যেসব তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেগুলিও উঠে এসেছে। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে পুরুষদের কর্মনিয়োগের পরিমাণ বেশি এবং মহিলাদের থেকে পুরুষদের কর্মহানির পরিমাণ ১৭.৬ শতাংশ বেশি।
তবে লকডাউনের যেসব পুরুষ কর্মরত ছিলেন, তাঁদের ফের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনার তুলনায় যেসব মহিলা লকডাউনের আগে কর্মরত ছিলেন, তাঁদের লকডাউনের পর ফের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা ২৩.৫ শতাংশ কম। এই পরিবারগুলির পুরুষ কর্তাদের লকডাউন পরবর্তী ক্ষেত্রে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা মহিলাদের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে ১১.৩ শতাংশ বেশি। জাতিগত ফারাক লিঙ্গগত ফারাকের তুলনায় কম, তবে লকডাউনে কর্মহীনদের মধ্যে তফশিলি জাতি-জনজাতি-অন্যান্য পশ্চাদপদ গোষ্ঠীর মানুষরা উচ্চবর্ণের মানুষদের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
মহিলা ও দলিতরা কর্মহীনতায় বেশি ভুগলেও, তাঁরাই বেশি ঝুঁকিপ্রবণ, বিপজ্জনক ও সমাজনিন্দিত কাের সঙ্গে যুক্ত। সমস্ত সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মী (আশাকর্মী)রাই মহিলা, মেথরের কাজ কেবল দলিতরাই করে থাকেন। ফলে বহু মহিলা ও দলিত কর্মহীনতা ও যেসব কাজে রোগ ও সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে, এই দুইয়ের মধ্যে থাকেন।
সরকারি ঘোষণা সত্ত্বেও আশাবাদী নয় এমএসএমই ক্ষেত্র
ভারতের অর্থনীতি লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ২০২০ সালের দ্য ইকোনমিস্ট। ভারতের বৃদ্ধির হার গত ৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম, ২০১৬ সাল থেকেই তা কমছে, এবং ২০২০ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে তা পৌঁছেছিল ৩.১ শতাংশে। আমার গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে কর্মহীনতা ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে, এবং যদি না বিশেষ নজর দেওয়া হয়, তাহলে লিঙ্গ ও জাতিগত পূর্ব বিদ্যমান অসাম্য আরও বাড়বে।
(অশ্বিনী দেশপাণ্ডে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক)