Mamata Banerjee and Calcutta HC order: স্কুল চাকরি কেলেঙ্কারিতে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে রীতিমতো বিপাকে তৃণমূল কংগ্রেস। একসঙ্গে ২৬ হাজার লোকের চাকরি গিয়েছে এই নির্দেশে। ২০২১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তার মধ্যেই গত সপ্তাহে ২৬ হাজার স্কুলশিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মীদের নিয়োগ বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। এত বড় ধাক্কা সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্য সরকার খায়নি। তাই, গত সপ্তাহে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ বর্তমান লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ঝড় তুলেছে।
প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য
শুক্রবার মালদা শহরে এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টিএমসি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে বলেন, 'টিএমসি বাংলার যুবকদের জীবন নিয়ে খেলছে। ব্যাপক নিয়োগ কেলেঙ্কারির কারণে প্রায় ২৬ হাজার লোক তাঁদের জীবিকা হারিয়েছে। এঁরা ঋণ নিয়ে চাকরি পাওয়ার জন্য টিএমসিকে দিয়েছিলেন, তাঁরা এখন রাস্তায়। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারই যুবকদের চাকরি দিচ্ছে।' জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'আপনারা ম্যান ইটার বাঘের কথা শুনেছেন। কিন্তু, চাকরি খাওয়া বিজেপির কথা শুনেছেন? আদালত এত লোককে বেকার করে দেওয়ার পরে আপনারা বিজেপি, সিপিএম আর কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে কী উল্লাস! দেখেছেন?'
কী বলেছে হাইকোর্ট?
২২ এপ্রিলের নির্দেশে, বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীদের নিয়োগ বাতিল করেছে। তাঁদের, 'প্রতিবছর ১২% হারে সুদের সঙ্গে প্রাপ্ত সমস্ত পারিশ্রমিক এবং সুবিধা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশ জারির চার সপ্তাহের মধ্যে তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।' এর পাশাপাশি, আদালত সিবিআইকে আরও তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে।
স্কুল চাকরি কেলেঙ্কারি কি?
বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ, ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, স্কুলে চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখার জন্য বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) রঞ্জিত বাগের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই বছরের ১২ মে বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট জমা দেয় কমিটি। যার ভিত্তিতে, বিচারপতি সুব্রত তালুকদার ও বিচারপতি আনন্দকুমার মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ স্কুলশিক্ষা বিভাগে গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কথিত অনিয়মের জন্য সিবিআই তদন্তের ব্যাপারে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশকে বহাল রাখে।
এ পর্যন্ত কারা গ্রেফতার হয়েছে?
এই মামলায় প্রথম হাই-প্রোফাইল গ্রেফতারের মধ্যে ছিল তৎকালীন টিএমসি নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী অর্পিতা মুখার্জি। সেটা ২০২২ সালের আগস্টের ঘটনা। এই মামলায় টিএমসি বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছে। পার্থ চ্যাটার্জির বেআইনি সম্পদ মামলায় ১০০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি তাঁর সঙ্গে যুক্ত করেছেন তদন্তকারীরা। উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকার নগদের বান্ডিল। পরে শাসক দল পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে রাজ্য মন্ত্রিসভা এবং দল থেকে বহিষ্কার করেছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্য, টিএমসি বিধায়ক এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য, টিএমসি বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা-সহ রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন আধিকারিকরাও এই মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন।
কেন এটা বড় রাজনৈতিক ধাক্কা?
চাকরি থেকে এই বরখাস্তের নির্দেশ লোকসভা নির্বাচনের সময় টিএমসির কাছে এক বড় ধাক্কা। টিএমসি এই পরিস্থিতিতে, এতজনের চাকরি খাওয়া উচিত নয় বলে- সেই ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশাপাশি, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাবে বলেও জানিয়েছে। আদালত যেদিন নির্দেশ দিয়েছে, সেদিনই উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে এক নির্বাচনী সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'সব রায় মেনে নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। আমরা এই আদেশকে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করব। নির্বাচনের মধ্যে বিজেপির নির্দেশে এই আদেশটি দেওয়া হয়েছে।'
অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য
বিজেপি এবং অন্যান্য দলগুলো এই পরিস্থিতিতে সরকারকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। বিরোধীরা অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করেছে। তমলুকের বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বিচারক থাকাকালীন শিক্ষা কেলেঙ্কারি সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি মামলার রায় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'আসল অপরাধীরা রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষপদে বসে আছে। যদি তাদের সাহস থাকে এবং তাদের মধ্যে লজ্জা থাকে, তবে তাঁদের ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তদন্তের মুখোমুখি হওয়া উচিত।'
আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের বক্তব্য
সিপিআইএম নেতা ও প্রবীণ আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, 'এটা প্রমাণ করে যে আদালত চাইলে সাংবিধানিক অধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের মুখোশ খুলে দিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, কিছু লোককে তাঁদের চাকরি হারাতে হবে। তবে, তাদের একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দলকে সমর্থন করার পরিণতি উপলব্ধি করা উচিত।'
আরও পড়ুন- প্রার্থীর বদলে রাজনৈতিক দলকে নোটিস! ভোটের বাজারে বিরাট রদবদল কমিশনের
বর্তমান সময়ে এই নিয়োগ দুর্নীতি বিজেপির জন্য, দুর্নীতিমুক্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রচারে একটি প্রধান নির্বাচনী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ২০২১ সালের রাজ্য নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে তিন বছরের মধ্যে বিজেপি এই ইস্যুতে টিএমসিকে কোণঠাসা করেছে। স্কুল চাকরি কেলেঙ্কারি ছাড়াও, যেখানে টিএমসি নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, সেগুলো হল- কয়লা এবং গবাদি পশুপাচার মামলা, পুরসভার চাকরি, রেশন বন্টন কেলেঙ্কারি। এর পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় তহবিল আটকানোর অভিযোগে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার মুখোমুখি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। বিজেপি অভিযোগ করেছে, সরকারি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অনিয়মের কারণে রাজ্যের তহবিল আটকে রাখা হয়েছে। সেই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে টিএমসি।