Advertisment

রাম মন্দির বানাবে এই কিংবদন্তী পরিবার, যারা দুশোর বেশি মন্দির বানিয়েছে দেশে-বিদেশে

আজ থেকে ৩০ বছর আগে তখন যেখানে বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়েছিল সেখানে প্রথমবার মন্দির নির্মাণের রূপরেখা তৈরি করতে গিয়েছিলেন এই স্থপতি পরিবারের প্রধান

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

‘ভূমি পূজন’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের সূচনা ঘটছে। এই মন্দির নির্মাণ করবে সম্পুরা পরিবার। আজ থেকে ৩০ বছর আগে তখন যেখানে বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়েছিল সেখানে প্রথমবার মন্দির নির্মাণের রূপরেখা তৈরি করতেGa গিয়েছিলেন এই স্থপতি পরিবারের প্রধান চন্দ্রকান্ত সম্পুরা।

Advertisment

সোমনাথ থেকে অযোধ্যা সব মন্দির এই পরিবারের হাত ধরে

৩ দশক আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অশোক সিংহলের সঙ্গে অযোধ্যায় গিয়েছিলেন আজ ৭৭ বছর বয়সী চন্দ্রকান্ত। শিল্পপতি ঘনশ্যমদাস বিড়লা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অশোক সিংহলের সঙ্গে। কারণ, এই চন্দ্রকান্ত সম্পুরার হাতেই তৈরি হয়েছে একাধিক বিড়লা মন্দির। ভারতজুড়ে অন্তত ২০০ মন্দিরের নির্মাতা এই পরিবার জানাচ্ছে, তাদের অভিজ্ঞতায় এই রাম মন্দিরই একমাত্র প্রকল্প যা নির্মাণে এত বেশি সময় লাগছে। চন্দ্রকান্তবাবুর কথায়, “সাধারণতঃ দু-তিন বছরের মধ্যেই ভূমি পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।” বুধবার ৫ আগস্ট নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে চন্দ্রকান্তও উপস্থিত থাকবেন রাম মন্দিরের ভূমি পূজা অনুষ্ঠানে।

তবে ৭৭ বছর বয়সী চন্দ্রকান্ত ঠিক করেছেন, তিনি আর দৈনন্দিনভাবে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ কাজে সশরীরে উপস্থিত থাকবেন না। বরং তাঁর পুত্র আশীস সেখানে উপস্থিত থেকে লারসেন এন্ড টুব্রো সংস্থাকে নির্মাণ কাজে পরামর্শ দেবেন।

আশীস মন্দির স্থাপত্যের আগ্রহ অর্জন করেছেন পৈত্রিক সূত্রে। তাঁর পিতা চন্দ্রকান্ত এবং পিতামহ প্রভাশঙ্করের কাছ থেকে। প্রভাশঙ্কর সম্পুরার হাতেই নির্মিত হয়েছিল গুজরাটের সোমনাথ মন্দির যা ১৯৫১ সালে উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি বাবুরাজেন্দ্র প্রসাদ। প্রভাশঙ্কর পরবর্তীকালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। প্রভাশঙ্করের আরেক পুত্র বলবন্তরাই ৫১ বছর বয়সে একটি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান যখন তিনি বদ্রীনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের কাজ দেখাশোনা করে ফিরছিলেন।

সম্পুরা পরিবারের আজও মনে করে সোমনাথ মন্দির নির্মাণই তাঁদের হৃদয়ের সবথেকে কাছাকাছি। তাঁদের বিশ্বাস, পূর্বপুরুষরা স্বয়ং বিশ্বকর্মার হাত থেকে স্থাপত্যবিদ্যা শিখেছিলেন। গুজরাটের ভাবনগরের এই পরিবার নিজেদের চন্দ্রের অধিবাসী বলে মনে করে, কারণ সম অর্থাৎ চন্দ্র এবং পুরা অর্থাৎ শহর। তাঁরা চন্দ্র শহরের অধিবাসী।

চন্দ্রকান্ত জানাচ্ছেন, তিনি নিজে কখনো প্রথাগতভাবে স্থাপত্যবিদ্যার পাঠ নেননি সম্পূর্ণটাই তার পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া জ্ঞান। তবে তাঁর পুত্র এবং পরিবারের অন্যান্যরা যাঁরা আজ মন্দির প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা সকলেই প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার অথবা স্থপতি।

তিন দশকের কাজ পেন্সিল স্কেচ থেকে শুরু

প্রথমবার যখন চন্দ্রকান্ত সম্পুরা তৎকালীন রাম মন্দিরের গর্ভগৃহের প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে কোনো রকম যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তাই তিনি নিজের পায়ের পাতার মাপে ভেতরের এলাকাটি মেপে নিয়েছিলেন এবং এর ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছিল প্রাথমিক পেন্সিল স্কেচ। এরপর সেই স্কেচকে ট্রেসিং পেপারে ছাপ তুলে রং করে নকশা তৈরি হয়েছিল। ঠিক এভাবেই ট্রেসিং পেপারের মাধ্যমে যখন সোমনাথ মন্দিরের নকশা তৈরি করছিলেন প্রভাশঙ্কর তখন তাঁকে সাহায্য করেছিলেন চন্দ্রকান্ত। আবার ১৯৯৩ সালে মথুরায় কৃষ্ণ জন্মস্থান মন্দির নির্মাণে চন্দ্রকান্তকে সাহায্য করেছিলেন তাঁর পুত্র আশীস।

প্রাথমিকভাবে রাম মন্দিরের জন্য 23 টি নকশা তৈরি করেছিলেন চন্দ্রকান্ত সম্পুরা। এর মধ্যে একটি অনুমোদন করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং সেই সময় ওই নকশা অনুযায়ী মন্দির নির্মাণের পথে এগোনর ভাবনা ছিল। একটি কাঠের মডেল তৈরি করা হয়েছিল, সে বছর কুম্ভ মেলায় সাধু-সন্তরা ওই মডেলটি অনুমোদন করেছিলেন।

চন্দ্রকান্তর এখন মনে পড়ছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং জানতে চেয়েছিলেন, মন্দির এবং মসজিদ দুটিকে রেখেই তিনি কোনো বিকল্প নকশা তৈরি করতে পারবেন কিনা। সেসময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ‘অযোধ্যা সেল’ গঠন করা হয়েছিল এ কথা জানা যায় রাও-এর আত্মজীবনী ‘অযোধ্যা ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২’ থেকে।

প্রধানমন্ত্রীর এই ডাক আসার পর মসজিদের তিনটি ডোমকে অক্ষুন্ন রেখে এবং তার পাশে মন্দিরকে স্থাপন করে একটি নকশা তৈরি করেছিলেন চন্দ্রকান্ত সম্পুরা। এই নকশাটি অনেকটা মথুরায় কৃষ্ণ জন্মস্থানের মতো। কিন্তু দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে সম্পুরা জানিয়েছিলেন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এ বিষয়ে অনড় ছিল। “যদি সঠিক জায়গায় মন্দির নির্মাণ না হয় তাহলে আমাদের কাছে তার আর কোন গুরুত্ব নেই। এটা সরযুর তীরে হতে পারে অথবা আমেদাবাদে”, এই ছিল বক্তব্য।

বাবরি ধ্বংসের পর দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এরপরই মন্দির প্রকল্প গতি পায়। এখন তো ওখানে আর মসজিদ নেই, ফলে রাম লালার জন্মস্থান বলে যে অংশটা কে বিশ্বাস করা হয় সেখানেই তৈরি হবে মন্দির।

১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ এর মধ্যে অযোধ্যার ‘কার্যশালায়’ পূর্ণ গতি পায় মন্দির নির্মাণের কাজ। কিন্তু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অর্থাভাব এবং নানা মামলায় জড়িয়ে পড়ার কারণে নির্মাণ কাজ ধীর হয়ে যায়। সেসময় মাত্র আট দশজন স্থপতি কাজ করছিলেন সেখানে, মনে পড়েছে চন্দ্রকান্তবাবুর। তবে গত বছরের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ জমিটি মন্দির নির্মাণের জন্য বিয়ে দেওয়ায় খুব দ্রুত নির্মাণ কাজের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।

আজ থেকে পাঁচ বছর আগে শেষবারের জন্য অযোধ্যায় গিয়েছিলেন সম্পুরা পরিবার চন্দ্রকান্ত সম্পুরা। পুত্র নিখিল এবং আশীস এখন মন্দির নির্মাণের কাজের মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নিখিলের ২৮ বছর বয়সী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পুত্র আশুতোষ।

আশাসের উল্লেখযোগ্য কাজ, মুম্বাইয়ের আন্টিলায় আম্বানিদের ব্যক্তিগত মন্দির নির্মাণ। এছাড়া এই পরিবারের হাতেই তৈরি হয়েছে অক্ষরধাম মন্দির, অক্ষর পুরুষোত্তম স্বামীনারায়ণ সংস্থার মন্দির। লন্ডনের এই অক্ষর পুরুষোত্তম স্বামী নারায়ন মন্দিরের প্রধান, মহন্ত স্বামী, রাম মন্দিরের ভূমি পূজা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ৭ সাধুর অন্যতম।

এই অযোধ্যার রাম মন্দির কেমন দেখতে হবে?

রাম মন্দির তৈরি হবে নগর শৈলী অনুযায়ী। প্রাথমিকভাবে মন্দিরের আকার-আকৃতি যেমনটা হবে বলে ভাবা হয়েছিল বাস্তবে তা হতে চলেছে আরও অনেক বড়। তিনটি অতিরিক্ত কুণ্ডলী যোগ হচ্ছে মূল নকশার সঙ্গে। একটি সামনে এবং দুটি দু’পাশে। কুন্ডলীর উপর প্রশস্ত হবে ‘গূধ মন্ডপ’। মূল নকশায় ১৬০টি কলমের কথা বলা থাকলেও তা ৩৬৬তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে ১৬০ টি কলম থাকবে একতলায় ১৩২ টি থাকবে দোতালায়, ৭৪ টি থাকবে তিনতলায়। ‘রাম দরবার’ এর সিঁড়ির মাপও বদলেছে। ১৬ ফুট চওড়া হচ্ছে এই সিঁড়ি। মন্দিরের উচ্চতা প্রাথমিকভাবে ১৪১ ফুট নির্ধারিত হলেও শেষ পর্যন্ত ১৬১ ফুট হবে বলে ঠিক হয়েছে। ২৩৫ ফুট আগে নির্ধারিত ছিল। ১৬০ ফুট মন্দিরের দৈর্ঘ্য ২৮০ ফুট থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০৭ ফুট। সবদিক থেকে মন্দিরের আকার বাড়ানো হয়েছে কারণ, সরকার চেয়েছে মন্দিরে যাতে আরো বেশি করে মানুষ স্থান পায়, এমনটাই জানাচ্ছেন সম্পুরা পরিবারের সদস্য আশীস। পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রত্যেকটি কলমে ১৬ টি মূর্তি থাকবে। এই মুর্তিগুলির মধ্যে থাকবে দশাবতার, ৬৪ যোগিনী, শিবের সবরকম রূপ এবং সরস্বতী দেবীর ১২ রূপ।
রাম মন্দিরের অনন্য বৈশিষ্ট্য হবে অষ্টভুজাকার আকৃতি। এই রাম মন্দিরে থাকবে হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্যের প্রায় প্রতিটি নিদর্শন, যেমন চৌকি নৃত্য, গর্ভগৃহ।

এই বিশালাকার মন্দির নির্মাণ করতে মোটামুটি সাড়ে তিন বছর সময় লাগবে বলে অনুমান সম্পুরা পরিবারের। কিন্তু করোনা অতিমারীর পরিস্থিতিতে গোটা কাজটি আরও ছয় থেকে আট মাস পিছিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তিনটি ঠিকাদার সংস্থাকে মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছিল যা বর্তমানে একা লার্সেন এন্ড টুব্রো সামলাচ্ছে।

Read in English

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Ram Temple Ayodhya
Advertisment