Advertisment

Explained: পাকিস্তানের 'কায়েদ-ই-আজম', জিন্নাহর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন দুই মহিলা?

বড়দিনে ১৪৭তম জন্মবার্ষিকী পালিত হল পাকিস্তানের 'বাবা-এ-কউম' এর।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Jinnah

তাঁর পাকিস্তান তৈরির সুখ বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি জিন্নাহ। পরের বছরই, ১৯৪৮ সালে যক্ষ্মায় ভুগে মারা যান। (এক্সপ্রেস আর্কাইভস)

সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর অর্থাৎ বড়দিনেই পালিত হল পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্নাহর ১৪৭তম জন্মবার্ষিকী। জিন্নাহর উত্তাল রাজনৈতিক জীবন নিয়ে লেখাপড়া বা পাণ্ডিত্যের অভাব নেই। তবে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, বিশেষ করে তাঁর জীবনে জড়িয়ে থাকা মহিলাদের ব্যাপারে খুব বেশি লেখা প্রকাশিত হয়নি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, জিন্নাহর দুই বিয়ে। তবে, তাঁর একমাত্র সন্তান একটি মেয়ে। পাকিস্তানি-আমেরিকান শিক্ষাবিদ ও প্রাক্তন কূটনীতিক আকবর এস আহমেদের 'জিন্নাহ, পাকিস্তান এবং ইসলামিক আইডেন্টিটি: দ্য সার্চ ফর সালাদিন' অনুসারে জিন্নাহর সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রত্তনবাই ওরফে রুত্তি ও মেয়ে দিনা।

Advertisment

রত্তনবাই জিন্নাহ
জাতে পার্সি, বছর ১৮-র রত্তনবাই বাবার অমতে ১৯১৮-র প্রথম দিকে জিন্নাহকে বিয়ে করেছিলেন। সেই সময় জিন্নাহ ৪২। তিনি রত্তনবাইয়ের দ্বিগুণেরও বেশি বয়সিই শুধু ছিলেন না, ছিলেন ভিন্ন ধর্মেরও। আহমেদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, 'স্যার দিনাশ পেতিত (রতনবাইয়ের বাবা) যখন তাঁর বন্ধু জিন্নাহর থেকে তাঁর মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন, রীতিমতো রেগে যান। পার্সিরা একটি ধনী এবং পরিশীলিত পশ্চিমী সম্প্রদায়। বম্বেতে তাঁরা রীতিমতো আধিপত্য বিস্তার করেছিল। রুত্তি তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের থেকেই কোনও যুবককে স্বামী হিসেবে বেছে নিতে পারতেন।'

পশ্চিমী পোশাকে বিতর্ক বাধে
তার ওপর রত্তনবাই, 'বোম্বাইয়ের ফুল' নামে পরিচিত ছিলেন। এমন একজন ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্ন নারী, যিনি ভালো পাঠক। কবিতা ও শিল্পকলার মর্যাদা বুঝতেন। তিনি সেই সময় বোম্বেতে পতিতালয় বিলুপ্ত করার জন্য এবং পশুহত্যা বন্ধের জন্য প্রচারও চালিয়েছিলেন। লেখক শরিফ আল-মুজাহিদ তাঁর প্রবন্ধ, 'জিন্নাহ: একটি প্রতিকৃতি, দ্য জিন্নাহ অ্যান্থলজি'তে লিখেছেন যে রতনবাই, 'তাঁর (জিন্নাহ) জন্য এক নতুন জগৎ খুলে দিয়েছিলেন।' তাঁদের বিয়ের একবছরের মধ্যে, ১৯১৯ সালে জিন্নাহ মুসলিম লিগের সভাপতি হন। রত্তনবাই, সেই মুসলিম লিগের সভায় জিন্নাহর সঙ্গে মঞ্চ ভাগাভাগি করেছিলেন। তাঁর পশ্চিমী পোশাক সমাবেশে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।

আপত্তি বাড়তে থাকে
১৯২৪-এ মুসলিম লিগের বার্ষিক অধিবেশন হয়েছিল বম্বের গ্লোব সিনেমা হলে। সাদ এস খান এবং সারা এস খান, তাঁদের বই, 'রুত্তি জিন্নাহ: দ্য ওম্যান হু স্ট্যান্ড ডিফিয়েন্ট'-এ লিখেছেন- 'দর্শকদের মধ্যে কিছু লোক আয়োজকদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মহিলাটি কে? জিন্নাহর রাজনৈতিক সচিব এমসি ছাগলাকে এই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। তিনি ওই অভিযোগকারীদের বলেছিলেন যে, ওই মহিলা মুসলিম লিগের সভাপতির স্ত্রী। তাই ওই মহিলা সম্পর্কে কোনও অভিযোগ শোনা হবে না। এই ঘটনাই ইঙ্গিত দেয় যে মিসেস জিন্নাহ কেবল বেড়ার বাইরে থেকে উল্লাস প্রকাশ করা একজন নিষ্ক্রিয় সহচরী ছিলেন না। জিন্নাহর সঙ্গে লাইমলাইটও সমান ভাবে ভাগ করে নিতেন। তবে, তাতে অভিযোগ বা আপত্তিও বাড়তে থাকে।

রত্তনবাইয়ের মৃত্যু
রত্তনবাই ও জিন্নাহ তাঁদের বিয়ের কয়েক বছর পরেই আলাদা থাকতে বাধ্য হন। জিন্নাহ আরও বেশি করে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে জড়িয়ে পড়ায় তাঁরা আলাদা থাকতে বাধ্য হন। এই সময় রত্তনবাই অসুস্থ হয়ে পড়লে, ফের জিন্নাহ তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে ছুটে আসেন। শেষ পর্যন্ত রত্তনবাই ১৯২৯ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে মারা যান। যদিও তাঁর মৃত্যুর কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। আহমেদ লিখেছেন, 'রুত্তির মৃত্যু জিন্নাহকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। যখন রুত্তির মৃতদেহ কবরে নামানো হয়, জিন্নাহ শিশুর মত কেঁদেছিলেন। তাঁর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না।'

দিনা ওয়াদিয়া
সেই সময় জিন্নাহর মেয়ে দিনার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। তাঁকে দেখভালের দায়িত্ব জিন্নাহ দিয়েছিলেন তাঁর বোন ফতিমাকে। মেয়ে ও বোনকে নিয়ে জিন্নাহ কিছুদিনের জন্য লন্ডনে চলে যান। এই সময় দিনা তাঁর বাবা জিন্নাহ সাহচর্যে বেড়ে ওঠেন। হেক্টর বলিথোরের, 'জিন্নাহ: পাকিস্তানের স্রষ্টা (১৯৫৪)' অনুসারে, 'ভারতের ঘেরাটোপের রাজনীতি থেকে দূরে চাপমুক্ত পরিবেশ', বাবা এবং মেয়ের স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। বলিথো লিখেছেন, 'তিনি (দিনা) একাই তাঁর বাবাকে জ্বালাতন করতে পারতেন। এমন একটি পছন্দের আচরণ তিনি করতে পারতেন, যার প্রতি তাঁর সারাজীবন ধরে প্রত্যাশা ছিল। অভাববোধ ছিল।'

মেয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ
কিন্তু, তাঁদের সম্পর্ক সেই সময় তিক্ত হয়ে ওঠে, যখন দিনা স্থির করেন যে তিনি নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করবেন। নেভিল ছিলেন একজন পার্সি। জিন্নাহ সেই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। আহমেদ তার বইতে লিখেছেন যে জিন্নাহ তার মেয়েকে বলেছিলেন যে ভারতে লক্ষ লক্ষ মুসলিম ছেলে আছে। দিনা তার মধ্যে যে কাউকে হোক, বেছে নিতে পারেন। দিনার উত্তর ছিল যে লক্ষ লক্ষ মুসলিম মেয়েও আছে। জিন্নাহ তাঁদের একজনকে বিয়ে করতে পারতেন। তা না-করে কেন তিনি তাঁর মাকেই বিয়ে করছিলেন? শেষ পর্যন্ত, দিনা ১৯৩৮ সালে নেভিলকে বিয়ে করেন। আর, বাবা-মায়ের চূড়ান্ত টানাপোড়েনের মধ্যেই জিন্নাহ তাঁর মেয়েকে অস্বীকার করেন। তবে, এরপরও বাবা ও মেয়ের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু, সেটা স্রেফ চিঠিতে।

আরও পড়ুন- বড়দিনে ক্রিসমাস ট্রি ছাড়া ভাবাই যায় না, কীভাবে চালু হল এই প্রথা?

দেশভাগে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন বাবা-মেয়ে
এরপর দেশভাগ হয়। জিন্নাহ দিনাকে পাকিস্তানে আসতে আর বম্বের জীবন ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু, দিনা তাঁর স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গেই থাকার রাস্তা বেছে নেন। পরের বছরই জিন্নাহ যক্ষ্মা রোগে মারা যান। দিনা আর তাঁর বাবাকে দেখতে পাননি। আহমেদ লিখেছেন, 'বাবা ও কন্যার এই বিভাজন, বৃহত্তর ভারতবর্ষের বিভাজনের অংশ হয়ে ওঠে। যার ট্র্যাজেডি দেশভাগের রূপক বলা যেতে পারে।' এর পরবর্তী বছরগুলোয়, দিনা বেশিরভাগ সময় নিউইয়র্কে থাকতেন। তবে, তাঁর পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য মুম্বইয়ে প্রতিবছর আসতেন। শুধু তাই নয়, তিনি মালাবার হিলের দক্ষিণে তাঁদের বাড়ির অধিকার নিয়ে মামলাতেও জড়িয়ে পড়েন। সেই বাড়ি বর্তমানে 'জিন্নাহ হাউস' নামে পরিচিত। ইউরোপীয় শৈলীতে স্থপতি ক্লদ ব্যাটলি বাড়িটির ডিজাইন করেছিলেন। জিন্নাহ ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে সেখানেই থাকতেন। দিনা ৯৮ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর, নিউইয়র্কের বাড়িতে মারা যান।

pakistan India Partition
Advertisment