গত সপ্তাহে মেঘালয়ে জাতি দাঙ্গায় তিনজনের প্রাণহানি হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এক গ্রামে সংঘর্ষে এক খাসি জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত মারা গিয়েছেন। এরপর শিলংয়ে মুখোশধারী হানাদারদের বেপরোয়া ছোরা চালানোর ঘটনা ও অন্যান্য আক্রমণে মারা গিয়েছেন দুজন অ-জনজাতিভুক্ত। মৃতেরা দুজনেই মুসলিম। এই হিংসার ঘটনা মেঘালয়ের জাতিগত জটিলতা সামনে এনে দিয়েছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হওয়ার পর ফিরতে শুরু করেছে উত্তেজনা।
বহুজাতিক মেঘালয়
১৯৭২ সালে মেঘালয়কে আসাম থেকে বের করে নিয়ে এসে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। তার আগে পর্যন্ত বর্তমান মেঘালয়ের রাজধানী শিলং ছিল আসামের রাজধানী। বাংলাদেশের সঙ্গে ৪৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে মেঘালয়ের। কয়েক দশক ধরে বর্তমান বাংলাদেশ থেকে যেমন এ রাজ্যে অভিবাসন ঘটেছে, তেমনই আসাম হয়ে অন্য রাজ্যের বাসিন্দারাও এখানে এসে পৌঁছেছেন। জনজাতি গোষ্ঠী ছাড়াও মেঘালয়ের বাসিন্দাদের মধ্যে বাঙালি, নেপালি, মারওয়াড়ি, বিহারি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সদস্যরা রয়েছেন।
মেঘালয় একটি জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা। খাসি, জয়ন্তিয়া এবং গারো জনজাতিভুক্তদের জন্য সরকারি চাকরির ৮০ শতাংশ সংরক্ষিত। ১৯৭৮ সালে তৈরি হওয়া খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের মতো সংগঠনগুলির আশঙ্কা, বাংলাদেশ থেকে বেআইনি অভিবাসন এবং অন্যান্য রাজ্য থেকে বহিরাগতদের স্ফীতি জনজাতিগুলিকে গ্রাস করে নেবে।
মেঘালয় হিংসা: সিএএ প্রেক্ষিত
সংসদে ডিসেম্বর মাসে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বাংলাদেশি হিন্দুদের জন্য (তিন দেশের ছ'টি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে) ভারতীয় নাগরিকত্বের আবেদনের নিয়মাবলী শিথিল করেছে। তার দীর্ঘদিন আগে থেকেই এই আইন নিয়ে উত্তর-পূর্বে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। তার মধ্যে ছিল মেঘালয়ও। ঘটনাচক্রে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেয় ষষ্ঠ তফশিলভুক্ত এলাকায় সিএএ লাগু হবে না। সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলে উত্তর-পূর্বের বেশ কিছু এলাকায় প্রশাসনিক বিষয়ে বিশেষ বিধি রয়েছে। এর মধ্যে পড়ে মেঘালয়ের প্রায় পুরোটাই।
বড় ছাড় সত্ত্বেও মেঘালয়ে উদ্বেগ রয়েই গিয়েছে এবং ইনার লাইন পারমিটের দাবি নতুন করে উঠেছে। আইএলপি ব্যবস্থা চালু হলে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিককে মেঘালয়ে যেতে হলে নির্দিষ্ট সময়সীমার পারমিট দেওয়া হবে।
গত সপ্তাহের হিংসার সঙ্গে সিএএ-বিরোধী প্রচার ও আইএলপি-র দাবির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। গত শুক্রবার খাসি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন এই দুই বিষয়ে সভা করতে বাংলাদেশ সীমান্তের ইছামতী গ্রামে যায়। এই প্রচার চলাকালীন ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে অনাদিবাসী গ্রামবাসীদের সংঘর্ষ শুরু হয়, যার জেরে মারা যান একজন খাসি জনজাতিভুক্ত পুরুষ।
এর পরে রাজ্যের অন্যত্র হিংসা শুরু হয়, অনাদিবাসীদের টার্গেট করা হতে থাকে। সিংয়ে মুখোশধারী জনতার ছোরার আঘাতে অন্তত ১০ জন আহত হন, তাঁদের মধ্যে এক আসামবাসী মুসলিমের মৃত্যুও হয়। পিরকেন গ্রামে এক খাসি মহিলার মুসলিম স্বামীর মৃত্যু হয়।
সীমান্তের আসল বিষয়
ইছামতী গ্রামের বাসিন্দারা মিশ্র সম্প্রদায়ের, মূলত বাঙালি হিন্দুদের বাস হলেও, এখানে রয়েছেন মণিপুরি ও হাজংরা। খাসি ছাত্রকর্মীর মৃত্যুর পর পাঁচজন বাঙালি ও তিনজন মণিপুরিকে গ্রেফতার করা হয়। খাসি ছাত্র সংগঠনের এক সদস্যের কথায়, ইছামতীর অজনজাতিরা সিএএ-র বিরুদ্ধেও নন, আইএলপি-ও চান না, সে কারণেই ওই এলাকায় ছাত্রসংগঠন আক্রান্ত হয়।
শিংল টাইমসের সম্পাদক প্যাট্রিশিয়া মুখিমের কথায় "সিএএ-আইএলপি গোটা সমস্যা নতুন করে বাড়িয়ে তুলেছে এবং যারা সাধারণ সময়ে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে, তাদের মধ্যে শত্রুতা বাড়িয়েছে।" ইছামতীর হিংসার সঙ্গে সীমান্তের ওপারে চুনের ব্যবসা ও গবাদি পশু পাচারের যোগসাজশ রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
মুখিম বলেন, "ইছামতী এবং নিকটবর্তী ভোলাগঞ্জে খাসি ও গারোর চেয়ে বাঙালির সংখ্যা বেশি। একসময়ে যারা একসঙ্গে ছিল, তাদের মধ্যে সীমানা টেনে দুটি দেশে পরিণত করে দিলে এরকমই হয়... গত বছর সীমান্তের ওপার থেকে লোক এসে শীলা, ইছামতী এলাকায় জনজাতিদের উপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ।"
শিলং, তখন ও এখন
গত চার দশক ধরে শিলংয়ে বহিরাগতদের উপর হিংসা চলছে। ১৯৭৯ সালে বাঙালিরা, ১৯৮৭ সালে নেপালিরা, ১৯৯২ সালে বিহারিরা টার্গেট ছিল। ২০১৮ সালে খাসিদের সঙ্গে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে শিলংয়ের বাসিন্দা পাঞ্জাবি দলিত-শিখদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
নর্থ-ইস্ট হিল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইতিহাসবিদ বিনায়ক দত্ত, ২০১৩ সালে এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন কীভাবে বাঙালি, নেপালি, মারওয়াড়ি এবং বিহারিরা একসঙ্গে শিলংয়ের বহুজাতিক ক্ষেত্রে বেড়ে উঠেছেন। তিনি লিখছেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে জনজাতিদের স্বার্থরক্ষার জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তাকে মনে করা হলো জনজাতি এলাকায় জনজাতি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জায়গা।
২০০৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সি আর লিংডো এবং এল এস গাসা 'ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি'তে লিখেছেন, ১৯৭০ ও ১৯৮০-তে মেঘালয় রাজ্যে বিদেশিদের বেআইনি বসবাসের বিষয়টি রাজ্য রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালে রাজ্য গড়ে ওঠার পর প্রথমবার সংকটের মুখে পড়ে। তাঁরা আরও বলেন, এই সমস্ত ক্ষেত্রেই অনাদিবাসী সম্প্রদায় সর্বদাই পিছনের দিকে ছিলেন।
পুরোনো উদ্বেগ, নতুন করে
সাম্প্রতিক হিংসায় ৫২ বছরের জাড্ডু চৌধুরীর কাঁধে দুবার ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। আসামের বাঙালি অধ্যুষিত শহর শিলচরের এই বাসিন্দা শিলংয়ে ১৯৮২ সাল থেকে সব্জি বিক্রি করেন। এই প্রথম মুখোশধারী মানুষের শিলংয়ের রাস্তায় লোককে ছুরি মারার দৃশ্য দেখলেন তিনি।
সমাজকর্মী অ্যাঞ্জেলা রঙ্গদ "একে অপরকে ভাল করে জানা ও সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠার" ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। "বহিরাগতের বিপদ, এই ধারণা থেকে আমাদের বেরোতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে বিপদটা ঠিক কী? যাঁরা এখানে জীবনধারণের জন্য আসছেন, তাঁরা কি জনজাতিদের কাছে বিপদস্বরূপ? যাঁরা বাইরে থেকে এখানে রোজগার করতে আসছেন, তাঁদের জন্য আমাদের কঠোর শ্রম আইন থাকা উচিত, যাতে তাঁরা এলাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে বিপদ না হয়ে ওঠেন এবং অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে তাঁদের অধিকারও থাকা উচিত, কারণ তাঁরা স্থানীয় অর্থনীতিতে সাহায্য করেন, এবং তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা উচিত। আমাদের লোকেরাও বাইরে যায় এবং রোজগার করে।"
মুখিম বলেন, "আমাদের তরুণ-তরুণীরাও কাজ ও শিক্ষার জন্য বাইরে যাচ্ছে। যদি তারা দিল্লি বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা নয় বলে তাদের খেদিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কেমন লাগবে?" তিনি বলেন, "জনজাতিদের মধ্যে যে আশঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতার মানসিকতা রয়েছে তা দূর করতে সরকারকে কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তা সম্ভব দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন প্রশাসন এবং দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকারের প্রেক্ষিতেই।"