২৫ মার্চ ঘোষিত লকডাউনের ফলে পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত আলোচনায় মূল সমস্যা হল, কতজন বাস্তুচ্যুত হলেন, তার নির্দিষ্ট হিসেব না-থাকা।
বিভিন্ন সরকারি হিসেব- গত সপ্তাহে মুখ্য শ্রম কমিশনার জানিয়েছেন সারা দেশে ২৬ লক্ষ পরিযায়ী আটকে রয়েছেন, এঁদের মধ্যে ১০ শতাংশ ত্রাণ শিবিরে, ৪৩ শতাংশ কাজের জায়গায় ও ৪৬ শতাংশ অন্যান্য জায়গায় আটকে রয়েছেন বলে জানান হয়েছে। অন্য দিকে সুপ্রিম কোর্টে দেশের সলিসিটর জেনারেল জানিয়েছেন, ৯৭ লক্ষ জনকে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
রাজ্যগুলির মধ্যে উত্তর প্রদেশ জানিয়েছে ২১.৬৯ লক্ষ শ্রমিক ফেরত এসেছেন এবং তারা ১.৩৫ লক্ষ শ্রমিককে ফেরত পাঠিয়েছে। বিহার বলেছে ১০ লক্ষ শ্রমিক ফিরে এসেছেন, মহারাষ্ট্র জানিয়েছে ১১ লক্ষ শ্রমিক রাজ্য ছেড়েছেন। গুজরাট জানিয়েছে ২০.৫ লক্ষ শ্রমিক বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ বলেছে অন্য রাজ্যের ৩,৯৭,৩৯৮ জন পরিযায়ী কর্মী আটকে রয়েছেন। কর্নাটক আদালতে জানিয়েছে ৩ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের ফেরার ব্যবস্থা করেছে তারা।
আরও পড়ুন, লকডাউনজনিত কর্মহানিতে লিঙ্গগত তারতম্য
গবেষক ও বিষয়টিতে যাঁরা নজর রেখে চলেছেন, তাঁদের হিসেব বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা অনেক বেশি।
২০১৭ সালের দ্য ইকোনমিক সার্ভেতে একটি পরিচ্ছেদের নাম ছিল ‘India On the Move and Churning: New Evidence’। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি বলে মনে করা হয়, কারণ এখানে ছিল তখনকার সময়ের আভ্যন্তরীণ পরিযায়ী বা যেসব শ্রমিক গ্রামীণ ভারত থেকে শহরাঞ্চলে কাজের খোঁজে আসেন, তাঁদের সংখ্যা। সে হিসেবে সে সময়ে আন্তঃরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৬০ মিলিয়ন।
সে সময়ের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দি সুব্রহ্মণিয়ম এখন বলেছেন পরিযায়ী সম্পর্কিত পরিসংখ্যান পরিযায়ীদের গতিমুখ ও পরিমাণের হিসেব রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্লেষক হতে পারে। "যদি আমরা জানতে পারি যে পরিযায়ীরা মূলত কোথা থেকে আসছেন ও কোথায় যাচ্ছেন, তাহলে এর ফলে আমরা নীতি নির্ধারণে অগ্রাধিকার দিতে পারব যাতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সুনিশ্চিত করা যায়।" সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি নিজে কোনও হিসেব দেননি, তবে আমেদবাদের গবেষক চিন্ময় টুম্বের দেওয়া হিসেবের উল্লেখ করেছেন। চিন্ময় টুম্বে বর্তমানে ভারতের পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে কাজ করছেন।
আরও পড়ুন, কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে ভারতের অর্থনীতি?
চিন্ময় টুম্বে, ৩ কোটি- মার্চের মাঝামাঝি থেকে পাল্টা পরযানের হিসেব দিয়ে তিনি বলেছেন ভারতের শহরাঞ্চলের কর্মশক্তির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি। এই হিসেবটাকে রক্ষণশীল বলা চলে কারণ এতে রাজ্যের মধ্যবর্তী পরিযায়ী শ্রমিকদের হিসেব করা হয়নি। ট্রেনযাত্রা দিয়ে এই হিসেব কষা কতটা ঠিক সে নিয়েও তিনি অনিশ্চিত কারণ অধিকাংশই ট্রেনে না ফিরে সড়কপথে ফিরেছেন।
"প্রথম পর্যায়ে লকডাউনের ঠিক আগে অনেকে হোলির জন্য ফিরেছেন। রক্ষণশীল একটা হিসেব করলে দেখা যাবে যাঁরা সে সময়ে থেকে গিয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশই রাজ্যের অভ্যন্তরের পরিযায়ী। সে সংখ্যাটা ৫ মিলিয়নের মত। দ্বিতীয় পর্যায়ে মার্চ ২৫ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে একটা ব্যাপক তাড়াহুড়ো দেখা যায়, বিশেষ করে দিল্লি ও অন্যান্য জায়গা থেকে, যেখানে রাজ্য সরকার বাসের ব্যবস্থা করেছিল।
এরকম বেশ কিছু রিপোর্ট ও জেলাসীমান্তের রিপোর্টের ভিত্তিতে আমার হিসেবে ৫ মিলিয়ন একটা রক্ষণশীল সংখ্যা যা রাজ্যের মধ্যেকার পরযানে ঘটেছে। তৃতীয় পর্যায়ে, মে মাসে শ্রমিক ট্রেনে (৫ লক্ষ) এবং সড়ক পরিবহণে সবচেয়ে বেশি দলবদ্ধ প্রস্থানের ঘটনা ঘটেছে, যে সংখ্যাটা রক্ষণশীল হিসেবে ২০ মিলিয়ন।"
অধ্যাপক অমিতাভ কুণ্ডু ও তাঁর সহকর্মীরা, ২.২ কোটি- অর্থনীতিবিদ ও জনবিন্যাসকারী অমিতাভ কুণ্ডু, কেকে ভার্গিজ ও খালিদ খানের সঙ্গে একত্রে ২০২০-র মার্চ-এপ্রিলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের হিসেব করেছেন। তাঁদের হিসেবে এই সংখ্যাটা ২২ মিলিয়ন। কিন্তু এঁদের সকলে ফেরেননি। কুণ্ডুদের মতে, এঁদের মধ্যে ১২ মিলিয়ন ফিরেছেন। সম্ভবত বাকিদের ৬০ শতাংশ থেকে যাবেন। খরিফ শস্য কাটার কাজ শুরু হলে এঁদের মধ্যে ৪ মিলিয়ন ফিরে যাবেন, যদি না আগামী হপ্তাদুয়েকের মধ্যে শহুরে অর্থনীতিতে ব্যাপক কোনও অগ্রগতি ঘটে।
ডক্টর নর্মান মজিদ, ৫ মিলিয়ন- আই এলও-র সঙ্গে কর্মরত ডক্টর নর্মান মজিদের হিসেবে সংখ্যাটা ৫ লক্ষ- যাঁদের কোনও আশ্রয় ছিল না এবং মূলত যাঁরা অস্থায়ী কাজের সঙ্গে যুক্ত।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অফ ইন্ডিয়ার প্রধান তারিক থাচিলের মতে এই সংখ্যাহীনতাই প্রমাণ করে তাঁরা কোন দুরবস্থার শিকার।
"আমরা দেখছি এই জনসংখ্যার পরিমাণের হিসেবে কত পার্থক্য রয়েছে- আমি এই সংক্যা ৫০ থেকে ১৫০ মিলিয়নের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। শ্রমিক ট্রেনের পরিসংখ্যান ব্যবহার এই পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য রক্ষণশীল একটা হিসেবের উপাদান হতে পারে, কিন্তু ভারতের চক্রাকার পরযানের গুরুত্ব এবং তার নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ণয় করার পক্ষে এ ধরনের সংখ্যা অতীব সীমিত। এই গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র ও সমাজ কতটা অবজ্ঞা করে, সে অতিমারীর সময়ে বা তার আগে, এ থেকে তা বোঝা যায়। এই অবহেলার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে রয়েছে এই সংখ্যা নির্ণয় করার আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার অভাব (যেমন, NSS -এর হিসেব প্রায় সব গবেষকরাই পরিযায়ীদের সম্পর্কে ২০০৭-০৮-এর পরিসংখ্যান ব্যবহার করে থাকেন)।"