Advertisment

সারা দেশের পরিযায়ীরা- একটি বিশ্লেষণ

ভারতে আভ্যন্তরীণ পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ৪৫.৩৬ কোটি, দেশের মোট জনগণের ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন রাজ্যের অভ্যন্তরের পরিযায়ীরাও।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

দিল্লির আনন্দবিহারে পরিযায়ীদের বাড়ি ফেরার ভিড় (ছবি- প্রবীণ খান্না)

২১ দিনের লক ডাউন ঘোষণার পরেই পরিযায়ী শ্রমিকরা যেভাবে শহর ছাড়তে শুরু করেন, তা থেকে বোঝা গিয়েছে সারা ভারত জুড়ে বহু মানুষ নিজের রাজ্যের বাইরে কাজ করেন।

Advertisment

ভারতে আভ্যন্তরীণ পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ৪৫.৩৬ কোটি, দেশের মোট জনগণের ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন রাজ্যের অভ্যন্তরের পরিযায়ীরাও। তবে সম্প্রতি যে বাড়ি ফেরার ব্যাপকতা দেখা গিয়েছে, তা মূলত আন্তঃরাজ্য পরিযায়ীদের মধ্যেই।

২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ভারতের কর্মীশক্তির সংখ্যা ছিল ৪৮.২ কোটি। ২০১৬ সালের আর্থিক সমীক্ষায় অনুমান পরিযায়ী শ্রমশক্তির সংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ বা ১০ কোটির বেশি।

রাজ্য থেকে রাজ্য, ২০২০

আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের কোনও সরকারি পরিসংখ্যান এ দেশে পাওয়া যায় না। রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজের অধ্যাপক অমিতাভ কুণ্ডু ২০২০ সালের ব্যাপারে একটা আনুমানিক হিসেব কষেছেন।

তাঁর হিসেব ২০১১ সালের জনগণনা, এনএসএসও ও আর্থিক সমীক্ষাভিত্তিক। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ভারতে ৬৫ মিলিয়ন আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী রয়েছেন এবং তার ৩৩ শতাংশ শ্রমিক। খুব রক্ষণশীল একটা হিসেব করলেও এঁদের মধ্যে ৩০ শতাংশ ঠিকা শ্রমিক ও আরও ৩০ শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন।

যদি এর সঙ্গে ফুটপাথ বিক্রেতাদের ধরা হয়, তাহলে তাঁরা আরেকটি গোষ্ঠী, যাঁরা এই শ্রমিকদের পরিসংখ্যানের মধ্যেই নেই। এর অর্থ ১২ থেকে ১৮ মিলিয়ন আরও মানুষ রয়েছেন, যাঁরা ভিন রাজ্যে থাকেন।

সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ (সিএসডিএস) এবং আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯ সালের হিসেব অনুসারে ভারতের বড় শহরের জনসংখ্যার ২৯ শতাংশ দিন মজুর হিসেবে কর্মরত। এঁরা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের রাজ্যে ফিরতে চাইবেন।

অধ্যাপক কুণ্ডুর হিসেবে দেখা যাচ্ছে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের ২৫ শতাংশের উত্তরপ্রদেশে বাস ও বিহারের বাসিন্দা ১৪ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে রাজস্থান ও মধ্য প্রদেশ, যথাক্রমে ৬ ও ৫ শতাংশ। এর অর্থ ৪ থেকে ৬ মিলিয়ন মানুষ উত্তর প্রদেশে ফিরতে চাইবেন এবং ১.৮ থেকে ২.৮ মিলিয়ন মানুষ বিহারে। আরও ৬ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ মানুষ রাজস্থানে এবং ৬ থেকে ৯ লক্ষ মানুষ মধ্য প্রদেশে ফিরতে চাইবেন।

তাঁদের রোজগার ও অভিজ্ঞতা কীরকম

সিএসডিএস ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একটি সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা গিয়েছে ২২ শতাংশ দৈনিক ও সাপ্তাহিক মজুরদের মাসিক রোজগার ২০০০ টাকা পর্যন্ত, ৩২ শতাংশের রোজগার ২ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত, ২৫ শতাংশের রোজগার ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা, ১৩ শতাংশের রোজগার ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা, ৮ শতাংশের রোজগার ২০ হাজার টাকার বেশি। সিএসডিএসের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে দিল্লির সাম্প্রতিক ভোটের সময়ে ২০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দেখিয়েছেন তাঁদের মাসিক রোজগার ১০ হাজার টাকার কম। বিহার এবং উত্তর প্রদেশের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরও বেশি, যথাক্রমে ৩৩ শতাংশ ও ২৭ শতাংশ।

ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক থাচিল ভারতের চক্রাকার পরিযায়ী জনসমষ্টি নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এই পরিযায়ী জনসমষ্টিরর সকলে তাঁদের গ্রামভিত্তিক পরিচিতি ছেঁটে ফেলেন না, যে কারণে তাঁদের জীবনযাত্রার উৎপত্তি যখন ছিনিয়ে নেওয়া হল, সে সময়ে তাঁরা কয়েকশ বা কয়েক হাজার কিলোমিটার হাঁটতেও পিছ পা হননি।

তাঁর গবেষণার ভিত্তি ছিল লখনউয়ের বাজার এলাকার ২৪০০ মরশুমি পরিযায়ী। এঁদের শহরজীবনে পুলিশি প্রভাবের বিষয়টি তাঁর সমীক্ষায় উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ৩৩ শতাংশ ব্যক্তিগতভাবে শহরে হিংসাত্মক পুলিশি আগ্রাসনের মুখে পড়েছেন, নিজেদের গ্রামে এ সংখ্যাটা ছিল মাত্র ৫ শতাংশ।

মূলত শহরে

সাম্প্রতিক লক ডাউন ঘোষণার পর সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা গিয়েছিল দিল্লি, মুম্বই এবং সুরাটের মত শহরে। আইআইএম আহমেদাবাদের অধ্যাপক চিন্ময় তুম্বে দেখিয়েছিলেন দিল্লিতে পরিযায়ীর হার ৪৩ শতাংশ, যাঁদের ৮৮ শতাংশ ভিন রাজ্য থেকে এসেছেন এবং ৬৩ শতাংশ গ্রামীণ এলাকা থেকে।

মুম্বইয়ের পরিযায়ী হার ৫৫ শতাংশ, এঁদের ৪৬ শতাংশ অন্য রাজ্য থেকে এসেছেন এবং ৫২ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষেত্র থেকে। সুরাটে, যেখানে একদল পরিযায়ীর উপর পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটেছে, সেখানে পরিযায়ীর হার ৬৫ শতাংশ, এর ৫০ শতাংশ ভিন রাজ্য থেকে এবং ৭৬ শতাংশ এসেছেন গ্রামীণ ক্ষেত্র থেকে।

অধ্যাপক তুম্বে আরও বলেছেন পরিযায়ীদের নিজস্ব রাজ্যের জেলা, যেখানে তাঁরা ফিরবেন, সে সম্পর্কিত তথ্য সাম্প্রতিক নয় এবং তা ১৯৯০ সালের তথ্যের উপর নির্ভরশীল। তাঁর গবেষণাপত্র Urbanisation, Demographic Transition and the Growth of Cities in India, 1870-2020-তে দেওয়া বড় শহরের পরিযায়ীদের উৎস সম্পর্কিত তথ্য ১৯৯০ সালের তথ্য নির্ভর, কারণ ২০১১ সালের জনগণনার এ সম্পর্কিত তথ্য এখনও প্রকাশিত হয়নি।

এই জেলা চিহ্নিতকরণের কাজ অতীব জরুরি কারণ পরিযায়ী কর্মীরা নিজেদের অঞ্চলে ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে ফিরতে পারেন।

যেমন উপকূলবর্তী ওড়িশার গঞ্জাম জেলার অনেকেই গুজরাটে কাজ করেন এবং অধ্যাপক তুম্বে দেখিয়েছেন এর আগে এরকম তথ্য রয়েছে যেখানে সুরাট থেকে এইডস সংক্রমণ ছড়িয়েছে।

অধ্যাপক সিদ্ধার্থ চন্দ্রর গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯১৮ সালে উত্তর পর্দেশ ও বিহারের গ্রামীণ এলাকায় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সংক্রমতি হয়েছিল ইউরোপ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই  করা সেনাদের মাধ্যমে। এঁরা জাহাজে করে বম্বে ও মাদ্রাজে ফিরেছিলেন এবং নিজেদের এলাকায় ভাইরাস নিয়ে গিয়েছিলেন, যার জেরে ভারতে ১৮ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।

জেলা থেকে জেলা

 ২০১৬-১৭ সালের আর্থিক সমীক্ষা থেকে জেলাওয়ারি পরিযায়ী তথ্য যা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে দেশের মধ্যে যেসব জেলা শহরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পরিযায়ী রয়েছেন, সে তালিকার শীর্ষে রয়েছে গুরুগ্রাম, দিল্লি, মুম্বই, গৌতম বুদ্ধ নগর (উত্তর প্রদেশ), ইন্দোর, ভোপাল (মধ্যপ্রদেশ), বেঙ্গালুরু (কর্নাটক), তিরুভাল্লুর, চেন্নাই, কাঞ্চীপুরম, ইরোডে, কোয়েম্বাটোর (তামিলনাডু)।

যেসব জেলা থেকে পরিযায়ী কর্মীরা সবচেয়ে বেশি বাইরে গিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে মুজফফরনগর, বিজনোর, মোরাদাবাদ, রামপুর, কৌসাম্বি, ফৈজাবাদ, এবং উত্তর প্রদেশের আরও ৩৩টি জেলা, উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী, চামোলি, রুদ্রপ্রয়াগ, তেহরি গাড়োয়াল, রৌরি গাড়োয়াল, পিথোরাগড়, বাগেশ্বর, আলমোড়া, চম্পাবত, রাজস্থানের চুরু, ঝুনঝুনু, পালি, বিহারের দ্বারভাঙা, গোপালগঞ্জ, সিওয়ান, সারান, শেখপুরা, ভোজপুর, বক্সার, জেহানাবাদ এবং মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি ও সিন্ধুদুর্গ।

গৃহ ও দারিদ্র্যদূরীকরণ মন্ত্রকের অধীন পরিযায়ীদের নিয়ে কর্মরত গোষ্ঠীর ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুসারে ভারতের ১৭টি জেলার পুরুষদের ২৫ শতাংশ বাইরে কাজ করতে যান। এর মধ্যে উত্তর প্রদেশের তিনটি, বিহারের ৬টি এবং ওডিশার একটি জেলা রয়েছে।

ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে মহিলারা সবচেয়ে বেশি কাজ করেন নির্মাণশিল্পে (শহর এলাকায় ৬৭ শতাংশ ও গ্রামাঞ্চলে ৭৩ শতাংশ)। পুরুষ পরিযায়ী কর্মীদের বেশিরভাগই সরকারি কাজ (পরিবহণ, ডাক বিভাগ, প্রশাসন) এবং আধুনিক পরিষেবা (আর্থিক ক্ষেত্র, রিয়েল এস্টেট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য)য় যুক্ত। এঁদের ১৬ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায় ও ৪০ শতাংশ শহরাঞ্চলে কাজ করেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

coronavirus
Advertisment