সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) সোমবার একটি সংখ্যালঘু বৃত্তি 'কেলেঙ্কারি'তে একটি প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদন (এফআইআর) নথিভুক্ত করেছে। যাতে ৮৩০টি 'ভুয়ো' প্রতিষ্ঠান সুবিধা পেয়েছে বলে অভিযোগ। আর, এর ফলে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রকের ১৪৪ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। ২০১৭-১৮ এবং ২০২১-২২ অর্থবর্ষের মধ্যে এই কেলেঙ্কারি ঘটেছে বলেই অভিযোগ। এফআইআর দায়ের হয়েছে, 'অজানা নোডাল অফিসার, সরকারি ব্যাংকের কর্মচারী, ব্যক্তিগত ব্যক্তিদের' বিরুদ্ধে। এফআইআর উল্লেখ করেছে যে এই কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এসেছে, 'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন' থেকে। যার ভিত্তিতে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক প্রাথমিক ভাবে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। পরে, ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ (এনসিএইআর) বা জাতীয় ফলিত অর্থনৈতিক গবেষণা পরিষদ (এনসিএইআর) এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন- মাত্র কয়েক মিলিমিটার দূরত্ব, তাতেই চাঁদে তাপমাত্রার আকাশ-পাতাল ফারাক! হতবাক বিজ্ঞানীরা
এনসিএইআর ১,৫৭২টি প্রতিষ্ঠানে বৃত্তি প্রকল্পের মূল্যায়ন করেছে। দেখেছে যে, এই সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮৩০টি-ই 'ভুয়ো বা আংশিকভাবে জাল'। শুধু তাই নয়, এনসিএইআর রাজকোষে ১৪৪ কোটি টাকা লোকসানের কথাও জানিয়েছে। চলতি বছরের ১০ জুলাই সিবিআইকে একটি চিঠিতে 'পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের' অনুরোধ জানিয়ে, মন্ত্রকের সচিব ইন্দেবর পাণ্ডে ক্ষতির কথা জানিয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে মন্ত্রক ১.৮০ লক্ষেরও বেশি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়েছে। পাণ্ডে লিখেছেন, '(এটি) ইঙ্গিত দেয় যে সরকারের ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠান, আবেদনকারী, ইনস্টিটিউট/জেলা ও নোডাল অফিসারদের যোগসাজশ ছাড়া এই কেলেঙ্কারি সম্ভব হত না। কারণ, অর্থ সরাসরি সুবিধাভোগীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।' সিবিআইয়ের পিকে শ্রীবাস্তব এই মামলার তদন্তকারী অফিসার।
বৃত্তি প্রকল্প কি?
সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক তিনটি বৃত্তি প্রকল্প পরিচালনা করে: প্রাক-ম্যাট্রিক বৃত্তি, পোস্ট ম্যাট্রিক বৃত্তি, এবং মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ এবং পার্সি-সহ ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য মেধাবৃত্তি। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে শেষ হওয়া গত ৫ বছরে গড়ে ৬৫ লক্ষ শিক্ষার্থী প্রতিবছর বৃত্তি পেয়েছে। তহবিল সরাসরি ডিবিটি মোডে বা সরাসরি শিক্ষার্থীরা পেয়েছেন।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট করা বৃত্তি কেলেঙ্কারি কী?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রাক-ম্যাট্রিক স্কলারশিপ স্কিমটি তদন্ত করেছে। এই প্রকল্প ১ লক্ষ টাকার নীচে বার্ষিক আয়-সহ পরিবারের সংখ্যালঘু ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য। প্রতিবছর দুই স্তরে বৃত্তি দেওয়া হয়: ক্লাস ১ থেকে ৫-এর ছাত্ররা প্রতিবছর ১,০০০ টাকা পায় এবং ক্লাস ৬ থেকে ১০-এর ছাত্ররা হস্টেলের আবাসিক হলে ১০,৭০০ টাকা পায়। একজন অনাবাসিক কৃতি ছাত্র হলে ৫,৭০০ টাকা পায়। একমাসেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত একটি তদন্তমূলক সিরিজে ২০২০ সালের নভেম্বরে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস- ঝাড়খণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঞ্চলে হওয়া কেলেঙ্কারির ঘটনায় রিপোর্ট করেছে যে দালাল, ব্যাংককর্মী, স্কুলের কর্মচারী এবং রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা, পড়ুয়া এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরকে প্রতারণা করার অভিযোগে অভিযুক্ত। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ন্যাশনাল স্কলারশিপ পোর্টালে (এনএসপি) পাবলিক ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (পিএফএমএস)-এ নথিভুক্ত সুবিধাভোগী ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর তথ্য পরীক্ষা করেছে। কীভাবে একটি সরাসরি বেনিফিট ট্রান্সফার স্কিম দুর্নীতিবাজদের কবলে পড়ে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, তা সেই তদন্তে উঠে এসেছে। তদন্তে ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং অন্যান্য রাজ্যজুড়ে বৃত্তির পরিমাণ বণ্টনে জালিয়াতি এবং দুর্নীতির একাধিক উদাহরণ সামনে এসেছে।
সরকার প্রতিক্রিয়ায় কী জানিয়েছে?
ঝাড়খণ্ড, বিহার, অসম এবং অন্যান্য জায়গায় এই ঘটনাতে একাধিক এফআইআর নথিভুক্ত হয়েছে। এই রিপোর্টগুলির পরেই সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক বিষয়টিতে প্রাথমিকভাবে সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করেছে। যার রিপোর্ট এখনও জমা পড়েনি। পরবর্তী পর্যায়ে, এনসিএইআরকে তার তদন্ত চালানোর জন্য বলা হয়েছে। যা, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কোষাগারে ১৪৪.৩৩ কোটি টাকার ক্ষতির কথা জানিয়েছে। এফআইআর অনুসারে, ক্ষতি শুধুমাত্র সেই সময়ের জন্য গণনা করা যেতে পারে যে সময়ের জন্য মন্ত্রকের কাছে, 'এনএসপিতে পরিষ্কার ডিজিটাইজড ডেটা' আছে। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনকারীরা ২০১৭-১৮-এর আগের বছরগুলোতেও বৃত্তি পেয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তদন্তকারীরা।
NCAER-এর তদন্তের ফলাফল কী?
সিবিআই এফআইআর অনুসারে, এনসিএইআর রিপোর্ট, তার সংযোজনের অংশ হিসেবে বলেছে যে ইনস্টিটিউট নোডাল অফিসার (আইএনও) বা ডিস্ট্রিক্ট নোডাল অফিসার (ডিএনও) স্তরে সুবিধাভোগীদের যাচাইকরণের সঙ্গে আপস করেছিল। পড়ুয়াদের বৃত্তিটি কেটে নেওয়া হয়েছিল। ইনস্টিটিউট, ব্যাংক এবং সাইবার ক্যাফে মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে গোটা কেলেঙ্কারিটি ঘটেছিল। সাধারণভাবে যে অনিয়মগুলো হয়েছে, তা হল: তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগী কিছু প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু, ওই সব প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের সুবিধাগুলো গ্রহণ করছে। তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগীদের একাংশও 'ভুয়ো' বলে প্রমাণিত হয়েছে। জাল ছাত্রদের সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু, আবাসিকদের যাবতীয় পরিচিতি রাজ্য ও জেলার নোডাল অফিসাররা যাচাই করেছিলেন। যে সকল প্রতিষ্ঠানের UDISE বিবরণ ছিল (প্রতিটি স্কুলের জন্য একটি অনন্য নম্বর), কিন্তু NSP-তে ছিল না, সেগুলোকেই দুর্নীতিতে নিশানা করা হয়েছিল। NSP-তে নকল INO তৈরি করা হয়েছিল। জমা দেওয়া আবেদনগুলোর জন্য জেলা নোডাল অফিসারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে যাচাইকরণ এবং পুনঃপ্রমাণ করা হয়েছিল। কোনও শারীরিকভাবে যাচাইকরণ করা হয়নি। বিহারে, এটি উল্লেখ করা হয়েছে যে সরকারের তালিকায় নিবন্ধিত আইএনও ছিল সাইবার ক্যাফের মালিক, যারা 'সম্ভবত কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থীদের জন্য জাল আবেদন করেছিল।' মধ্যপ্রদেশের কিছু স্কুল জানিয়েছে যে তারা ক্লাস ৭- এর পরে স্বীকৃত ছিল না, তবুও ৮ম শ্রেণির এবং তার পরেও প্রচুর সংখ্যক পড়ুয়ার নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল।