Advertisment

মোদীর কথাই কি ঠিক, দেশভাগের পর সত্যিই হিন্দু ও মুসলিম শরণার্থীদের মধ্যে বিভাজন করা হয়েছিল?

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈকে এ চিঠিটি লিখেছিলেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সরকারের ক্যা লাগু করার সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই চিঠির উল্লেখ করেছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Partition, Muslim Refugee

পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা হিন্দু ও শিখ শরণার্থীদের জন্য বাড়ি ও সম্পত্তি সুলভ ছিল না

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (ক্যা) নিয়ে টানাপোড়েনের সঙ্গে সঙ্গেই এর পক্ষে ও বিপক্ষে নানা দাবি দাওয়া চলছে, যার জেরে ভারতীয় সমাজে একদিকে সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে বিভক্তি। নাগরিকত্ব নিয়ে বিবাদের জেরে ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্রের মৌলিক দিকগুলি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার নিয়ে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়েও।

Advertisment

ক্যা বিতর্কে যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে, যে সংকট বর্তমান মুহূর্তে তৈরি হয়েছে, তার চেয়ে কিন্তু দেশভাগের পরে উদ্ভূত যে পরিস্থিতি, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশের সৃষ্টি হচ্ছে, সে সময় অনেক জটিল ছিল।

আরও পড়ুন, দিল্লির হিংসা ঠেকাতে কেজরিওয়ালের সরকার কী করতে পারে, কী পারে না?

সে সময়ে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা যেমন তৈরি হয়েছিল, তেমনই সম্প্রদায়গত সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। সদ্যোজাত সরকারের সামনে ভারত ও পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু ও শিখদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব ছিল, একই সঙ্গে দায়িত্ব ছিল এ দেশে থাকতে মনস্থ করা বড় সংখ্যক মুসলিমদের সম্প্রদায়গত হিংসার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করা।

Partition, Muslim Refugee সংসদে ভাষণ দিচ্ছেন মোদী (ছবি- লোকসভা টিভি)

একথা ঠিক যে প্রতিষ্ঠাতাদের নেতৃত্বে এ দেশ ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে চেয়েছিল, কিন্তু সে নীতি কি তাঁরা দেশভাগের সময়ে তৈরি হওয়া স্বাধীন দেশের শিশু পদক্ষেপের মাধ্যমে নিতে পেরেছিলেন? হিন্দু, শিখ ও মুসলিমদের কি সমদৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয়েছিল, তাঁদের আপৎকালীন সময়ে কি তাঁদের সমস্যার একইভাবে পরিদর্শিত হয়েছিল? ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যবহার কি পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখদের প্রতি ব্যবহারের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি?

এর উত্তর পেতে গেলে একটা উপায় হল উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে মুখ্য ভূমিকা যাঁরা নিয়েছিলেন, তাঁদের মাধ্যমে বিষয়টি দেখা।

একটা চিঠি দিয়ে শুরু করা যাক। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈকে এ চিঠিটি লিখেছিলেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সরকারের ক্যা লাগু করার সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই চিঠির উল্লেখ করেছেন। মোদীর মতে, এই চিঠিতে (যা নেহরু-লিয়াকত চুক্তির এক বছর আগে লেখা) নেহরু স্পষ্ট ভাষায় বরদলৈকে শরণার্থী ও মুসলিম অভিবাসীদের মধ্যে তফাৎ করতে বলেছেন।

মোদী তাঁর ভাষণে চিঠিটি 'উদ্ধৃত' করে বলেন, "যাঁরা বলেন আমরা হিন্দু-মুসলমান করে দেশভাগ করছি, তাঁদের জন্য বলছি, মনে রাখবেন, নেহরু বলেছিলেন, ... আপনাকে শরণার্থী ও মুসলিম অভিবাসীদের মধ্যে তফাৎ করতে হবে, এবং দেশকে শরণার্থীদের দায়িত্ব নিতে হবে।"

নেহরুর চিঠিতে কী বলা ছিল?

নেহরু আসামের মুখ্যমন্ত্রী বরদলৈকে এ চিঠি লেখেন ১৯৪৮ সালের ৪ জুন। তার আগে আসাম সরকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসতে থাকা উদ্বাস্তুদের জায়গা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। মোদী যেমনভাবে নেহরুকে উদ্ধৃত করেছেন, ঠিক তেমনটা নেহরু লেখেননি। নেহরুর চিঠির পরের দুটি অনুচ্ছেদ পড়লে বোঝা যায় যে, যেসব মুসলিমরা ভারতে নিজেদের বাসস্থানে ফেরত আসতে চাইছেন, ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব  হিন্দুরা আসামে আসছেন, এ দুটি জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকার দুটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিল।

"আসামে মুসলিমদের প্রবেশ নিয়ে আপনি অসহায়তা ব্যক্ত করেছেন দেখে আমি অবাক হলাম। আপনি জানেন যে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পারমিট ব্যবস্থা রয়েছে। আমার মনে হয় না, পূর্ব বঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সেরকম কোনও পারমিট প্রথা রয়েছে, এবং আসামেও বোধহয় তেমনটা নেই। আমার মনে হয় আপনার ও বিষয়ে গোপালস্বামী আয়েঙ্গারের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত..."

"পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের প্রবেশের বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। আমাকে বলা হয়েছে আপনার সরকার বা আপনার মন্ত্রীদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলেছেন যে তাঁরা পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের চেয়ে পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের বেশি বাঞ্ছিত বলে মনে করেন। আমি জনগণের বিষয়ে সাম্প্রদায়িক অনুভব রহিত হওয়াই পছন্দ করি, আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু শরণার্থীদের আগমন নিয়ে স্পষ্ট আপত্তির বিষয়টা আমি বুঝতেই পারিনি। আমার আশঙ্কা, সংকীর্ণ নীতির জন্য আসামের নাম খারাপ হচ্ছে।"

দুই শরণার্থী গোষ্ঠীর মধ্যে স্পষ্ট তফাৎ করার নিদর্শন এটিই একমাত্র নয়। বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে বহু এমন চিঠি পাওয়া য়াবে, য়াতে দেখা যাবে হিন্দু ও শিখ শরণার্থীদের বাস্তুচ্যুত মুসলিমদের থেকে বেশি অগ্রাধিকার দেবার কোনও নীতি না থাকলেও তেমন মুসলিম পরিবারদের পুনর্বাসনের বিষয়টি সরকার ও সরকারের বাইরের অনেকের কাছেই বিস্বাদ লাগছে। এরকম ঘটনা বাড়তে থাকে স্বাধীনতার পাঁচ মাসের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর।

পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা হিন্দু ও শিখ শরণার্থীদের জন্য বাড়ি ও সম্পত্তি সুলভ ছিল না। তার ফলে উত্তর ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসা বাড়তে থাকে কারণ পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীরা এ দেশ ছেড়ে পাকিস্তান চলে যাওয়া মুসলিমদের বাড়িতে স্থান পাচ্ছিলেন। একইভাবে, শরণার্থীরা ও দেশ থেকে যে সন্ত্রাসের কাহিনি নিয়ে আসছিলেন, তার ভিত্তিতে স্থানীয় মুসলিমদের উপর যে প্রতিক্রিয়া ঘটছিল তার জেরে নিজেদের বাড়িতে শান্তিতে বসবাস করা মুসলিমদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছিল। যেসব মুসলিমরা শিবিরে ছিলেন, তাঁরাও বাড়ি ফিরতে পারছিলেন না। এর ফলে সরকার, বেসরকারিভাবে যেসব মুসলিমরা সন্ত্রাসের মাসগুলিতে পাকিস্তান গিয়েছিলেন, তাঁদের এ দেশে ফেরার ব্যাপারে নিরুৎসাহ করছিল।

বসতির সমস্যা

শরণার্থীদের মাথার উপর ছাদের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে সরকারের অক্ষমতা কীভাবে স্থানীয় মুসলিমদের উপর হিংসার কারণ হয়ে উঠল, তার স্পষ্ট উদাহরণ হতে পারে দিল্লির পরিস্থিতি।

সে সময়ের বিভিন্ন রিপোর্টে যে সংখ্যা পাওয়া গিয়েছে, তা অনুযায়ী, স্বাধীনতার এক সপ্তাহের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দিল্লিতে এসে পৌঁছন ১৩ হাজার শরণার্থী। (দিল্লিতে হিন্দু ও শিখ শরণার্থীর সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষের মত)।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিজের জমা দেওয়া পাক্ষিক রিপোর্টে দিল্লির কমিশনার সাহিবজাদা খুরশিদ বলেন, "দিল্লিতে যেসব হিন্দু ও শিখ শরণার্থীরা এসেছেন, তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন লুঠতরাজ ও ধর্ষণের কাহিনি, দিল্লিবাসী সম ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে তাঁরা সহানুভূতি পেয়েছেন এবং দিল্লির মুসলমানদের উপর পাল্টা হামলা শুরু করে দিয়েছেন।" এই রিপোর্টের উল্লেখ রয়েছে বাজিরা জমিনদারের The Long Partition and the Making of Modern South Asia-তে।

দিল্লিতে ১৯৪৭ সালের অগাস্ট-সেপ্টেম্বরের হিংসায় ২০ হাজার মুসলিম মারা যান। এর জেরে মুসলিমদের মধ্যে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি হয়। তাঁরা বাড়ি ছেড়ে পুরানা কিল্লা, নিজামউদ্দিন, হুমায়ুনের সমাধি ও জামা মসজিদ এলাকায় জড়ো হন এবং অন্য মুসলিমদের সঙ্গে মিলে নিরাপদ বোধ করতে থাকেন। এই শিবিরগুলির অতি খারাপ অবস্থার কথা সকলের কথাতেই উঠে এসেছে। শিবিরগুলি পাহারা দিতেন সাধারণ মুসিলমদের নিয়ে গঠিত স্পেশাল পুলিশ। এখান থেকে একটা বড় অংশ পাকিস্তানে চলে যান, একাংশের উদ্দেশ্য ছিল সেখানেই বাস করা, অন্য অংশ ভেবেছিলেন পরিস্থিতি শান্ত হলে তাঁরা দিল্লিতে নিজেদের বাড়িতে ফিরবেন।

পাকিস্তানে চলে যাওয়া বা শহরের মধ্যেই শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মুসলিমরা ফেলে যাচ্ছিলেন খালি বাড়ি। এই বাড়িগুলি বিবাদের বিন্দু হয়ে ওঠে। হিন্দু ও শিখ শরণার্থীরা বোধ করতে থাকেন, এ বাড়িগুলি তাঁদেরই দেওয়া উচিত, কারণ তাঁরা পাকিস্তানে নিজেদের সম্পত্তি ফেলে এসেছেন। বহু ক্ষেত্রে তাঁরা জোর করে এ সব বাড়ির দখল নিতে থাকেন। বেশ কয়েক জায়গায় এ সব বাড়ি নিরাপত্তা বাহিনী পাহারা দিলেও, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চিঠিপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, শয়ে শয়ে মানুষ এসে এসব বাড়ি দখল করার চেষ্টা করছিলেন। এরকম আক্রমণ কীভাবে ঘটছিল এবং নিরাপত্তা বাহিনী এই খালি বাড়িগুলি পাহারা দিতে কীভাবে অসমর্থ হচ্ছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় দিল্লি পুলিশের কমিশনারের সর্দার প্যাটেলকে পাঠানো এক রিপোর্টে। সেখানে তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারির এক রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে ফাটক হাবাশ খানের কাছে খালি বাড়ির দখল নিতে আসেন শয়ে শয়ে মহিলা, তাঁদের পিছনে ছিলেন হাজার হাজার শরণার্থী পুরুষ। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে হয়, লাঠি চার্জও করতে হয়।

দিল্লি শহরের পুলিশ সুপারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, "খালি বাড়িগুলি বণ্টন করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এই আইনশৃঙ্খলাহীনতা যাবে না। যদি এই পরিস্থিতি থাকে, তাহলে যে কোনও সময়ে শহরে আগুন জ্বলবে। শরণার্থী নারী-পুরুষরা অত্যন্ত মরিয়া হয়ে রয়েছেন এবং যে কোনও মূল্যে তাঁরা এই খালি বাড়িগুলি দখল করতে চান।"

এই সমস্যা নিরসনে সরকার উদ্বাস্তু সম্পত্তি আইন আনে, যে আইন আসলে করা হয়েছিল পাঞ্জাবের জন্য। এই আইনবলে, সম্পত্তির অধিকার উদ্বাস্তুরই থাকবে- ধরা যাক, হিংসার জন্য কোনও মুসলিম বাড়ি ছেড়ে গিয়েছেন - কিন্তু কাউকে তার রক্ষক নিয়োগ করে গিয়েছেন, যিনি সে সম্পত্তির দেখভাল করবেন, সেই রক্ষকের অধিকার থাকবে তাৎক্ষণিক বাসের জন্য সাময়িকভাবে সে বাড়ি শরণার্থীদের দেওয়ার। পরে সরকার সরকার একটি নীতি গ্রহণ করে, যার বলে কোনও অমুসলিম দখলদারকে সাময়িক আবাস থেকে উৎখাত করা যাবে না, যতদিন পর্যন্ত তাঁকে বিকল্প বাসস্থান দেওয়া যাচ্ছে।

বাজিরা জমিনদার লিখেছেন, "বাস্তবত যেসব মুসলমানরা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁদের বাড়ি একবার দখল হয়ে গেলে, দাঙ্গা ও হত্যা থামার পরও আর তাঁরা নিজের বাড়িতে ফিরতে পারেননি।"

এই পরিস্থিতিতে সরকারি আধিকারিকরা মনে করলেন, সবচেয়ে ভাল উপায় হল, হিংসার সময়ে যেসব মুসলমানরা পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন এবং এখন ফিরতে চান, তাঁদের নিরুৎসাহ করা। এর জন্য সবচেয়ে ভাল উপায় ছিল ভয়ের বার্তা, যে তাঁরা সাধারণ হিন্দু ও শিখ ও শরণার্থীদের ক্রোধের মুখে পড়তে পারেন। এই উদ্বেগের কথা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, তাঁর ১৯৪৮ সালের ২ মে-তে প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে লেখা চিঠিতে। এ চিঠিতে তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর কার্যকলাপের কথা উল্লেখ করেছেন।

প্যাটেল তাঁর চিঠিতে লিখছেন, "আমরা এখনও পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু ও শিখদের পুনর্বাসন দিতে পারিনি, এবং কাউকে পাকিস্তান ফেরত পাঠাতেও পারিনি। এ অবস্থায় যদি ওই মুসলিমরা ফেরেন, তাহলে শুধু শরণার্থীদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও অসন্তোষের পরিস্থিতি তৈরি হবে। এবং এই অসন্তোষের পরিস্থিতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজ তৈরি করবে, যার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে আরএসএসের মত সংগঠন।" মুসলিমদের ভারতে ফেরা নিয়ন্ত্রণ করতে, ভারত সরকার ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে কঠোর পারমিট ব্যবস্থা প্রণয়ন করল।

 ত্রাণ প্রকল্প মুসলিমদের কথা ভেবে তৈরি হয়নি

প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রকের আধিকারিকদের মধ্যে চিঠিপত্রেও দেখা যায় জাতীয় নেতাদের মধ্যে মুসলিম শরণার্থীদের পুনর্বাসন বিষয়টি ভারত সরকারের বিশেষ  মনোযোগের বিষয়ে কিনা তা নিয়ে মতান্তর হচ্ছে ।

১৯৪৮ সালের ১৯ মে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মোহনলাল সাক্সেনাকে নেহরু একটি চিঠি লিখে মুসলিম শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ অফিসার নিয়োগের অনুরোধ করে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে বিষয়টা স্পষ্ট।

নেহরু লিখেছেন, "দিল্লি, আজমীর, ভোপালের মুসলিম শরণার্থীরা, অর্থাৎ যে মুসলিম শরণার্থীরা কিছুদিনের জন্য চলে গিয়েছিলেন এবং ফিরে এসে দেখছেন তাঁদের বাড়ি হয় অন্যদের দখলে চলে গিয়েছে বা অন্যদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, তাঁদের জন্য কে দায়িত্বপ্রাপ্ত? কোনও একজনের এ ব্যাপারে এবং এ ধরনের সমস্ত মুসলিম শরণার্থীদের ব্যাপারে দায়িত্ব থাকা উচিত। আমরা আমাদের সহায়তা কেবল অমুসলিমদের জন্য বরাদ্দ করতে পারি না। নিশ্চিতভাবেই এটা ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রকের বিষয়। আমার মনে হয় একটা কোনও ব্যবস্থা থাকা দরকার, সে যাই হোক না কেন। আমার মনে হয় আপনার মন্ত্রকে মুসলিম শরণার্থী সমস্যার জন্য একজন স্পেশাল অফিসার থাকা প্রয়োজন।"

১৯৪৮ সালের ৩১ মে সাক্সেনাকে আরেকটি চিঠিতে নেহরু লিখেছেন, মুসলিম শরণার্থীদের প্রতিটি ঘটনাই আমাদের কাছে একটা পরীক্ষা। তবে তিনি মেনেও  নিচ্ছেন সরকারি অফিসারদের মধ্যে তাঁদের প্রতি খুব বেশি সহানুভূতি নেই।

নেহরু লিখেছিলেন, "ঘটনা হল আমাদের গোটা সংগঠনটাই গড়ে উঠেছে পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু ও শিখ শরণার্থীদের সাহায্যের কথা ভেবে। মুসলিমরা, যাদের অবস্থা ভিন্ন তাদের জন্য এটা প্রস্তুত নয়। এমনকি সরকারি দফতর ও তার বাইরেও মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি খুব বেশি না থাকতে পারে। তবে সরকার হিসেবে আমাদের উচিত এ ধরনের প্রতিটি ঘটনায় বিশেষ নজর দেওয়া কারণ  এ ধরনের প্রতিটি ঘটনা আমাদের সদিচ্ছার পরীক্ষা।"

মুসলিম শরণার্থীদের প্রতি বিশেষ নজর দেবার বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছিল ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রক। সাক্সেনা বলেছিলেন এর ফলে বিচার ব্যবস্থায় শর্ট সার্কিট পরিস্থিতি তৈরি হবে যার ফলে সরকার "গৃহহীন মানুষের ব্যাপক সমালোচনা"র মুখে পড়তে পারে। মন্ত্রকের উপদেষ্টা মেহর চাঁদ খান্না (যিনি নিজে পেশাওয়ারের শরণার্থী ছিলেন)ও  এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন মুসলিম শরণার্থী ও তাঁদের সম্পত্তি নিয়ে ভারত "অতীব নরম মনোভাব" নিচ্ছে এবং স্পেশাল অফিসার নিয়োগ করার অর্থ হবে "আইনকে ধোঁকা দেওয়া"।

মধ্যপন্থা

ভারত ধর্মনিরপেক্ষ পথে চলার কথা স্থির করলেও, দেশভাগ ও তার ফলে অভিবাসনের জেরে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। উদিতি সেন Citizen Refugee: Forging the Indian Nation after Partition-এ লিখেছেন, ভারতীয় নেতৃত্বকে জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী ধারণার মধ্যে দিেয় দড়ির উপর হাঁটতে হচ্ছিল। তাঁর মতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকাশ্য ঘোষণা থাকলেও হিন্দুত্বের প্রাধান্য শিকড় গেড়ে বসেছিল। এই পরিস্থিতিকে ধুনো দিয়েছিল প্রথমদিকে কোনও নাগরিকত্ব আইনের অনুপস্থিতি।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

caa
Advertisment