বোমা ফাটালেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব। গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে তিনি দাবি করেছেন, প্রায় ৩০০ বছর আগে গুপ্ত রাজা বিক্রমাদিত্যের আমলেই উজ্জয়িনী অর্থাৎ ভারত বিশ্বের সময় নির্ধারণ করেছিল। যা, প্যারিসের প্রাইম মেরিডিয়ান (লন্ডনের গ্রিনিচ মেরিডিয়ানের আগে) বা ইউরোপের উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধের ধারণা তৈরির অনেক আগেই ঘটেছিল। এই ব্যাপারে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় যাদব বলেন, 'পশ্চিমীকরণকে গ্রহণ বা আমাদের সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ অনেক হয়েছে, কিন্তু আর নয়। আমরা বিশ্বের সময় সংশোধন করার জন্য উজ্জয়িনীর মানমন্দিরে গবেষণা করব।' এতেই না-থেমে যাদব আরও বলেন, 'চিন, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান- সব দেশই বিশ্বাস করে যে, যদি সময় নির্ধারণের ব্যাপার হয়, তবে ভারতই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।' যাদবের এসব দাবির আদৌ কোনও ভিত্তি আছে কি না, চলুন দেখে নিই।
কখন থেকে মানুষ সঠিকভাবে সময় নির্ধারণের চেষ্টা করছে?
মানব জীবনে সময়ের মূল্য বোঝার চেষ্টা শুরু হয়েছিল বহু আগে থেকেই। প্রাচীন ভারতীয়রা চন্দ্র দিনের একক ( তিথি ) ব্যবহার করে তারিখগুলো লিপিবদ্ধ করত এবং সৌর ক্যালেন্ডারটি গুপ্তকাল থেকে চালু ছিল। জ্যোতিষশাস্ত্রীয় এবং গাণিতিক গণনার জন্য মোটামুটি সঠিক পরিমাপের প্রয়োজন। তবে, সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিদিনের অর্থে সঠিকভাবে সময় পরিমাপ করার কোনও উপায় সেই সময় ছিল না। শিল্প বিপ্লব, যা ১৮ শতকে ব্রিটেনে শুরু হয়েছিল এবং ইউরোপীয় মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত, অর্থনীতি অপ্রতিরোধ্যভাবে কৃষিনির্ভর ছিল। দিন এবং রাতের প্রাকৃতিক ছন্দ এবং ঋতুর আগমন এবং যাওয়া বেশিরভাগ মানুষের চাহিদা পূরণ করত। শিল্প বিপ্লব দুটি উপায়ে তা কিছুটা হলেও পরিবর্তন করে। ১৮ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আরও ভাল এবং আরও নির্ভুল ঘড়ি তৈরি করা শুরু হয়। আধুনিক কারখানার আবির্ভাবের সঙ্গে কেবল সময় মানাই নয়, সময়ের সর্বাধিক ব্যবহার করাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইতিহাসবিদ ইপি থম্পসন তাঁর ক্লাসিক দ্য মেকিং অফ দ্য ইংলিশ ওয়ার্কিং ক্লাস (১৯৬৩)-এ লিখেছেন, 'এটা স্পষ্ট যে ১৭৮০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল। গড়পরতা ইংরেজ শ্রমজীবী মানুষ আরও সুশৃঙ্খল হয়ে ওঠেন। ঘড়ির গতির অধীনে জীবন আরও উৎপাদনশীল, সংরক্ষিত এবং পদ্ধতিগত হয়ে ওঠে।'
তাহলে জাতীয় সময়ের ধারণার কখন উদ্ভব হল?
শিল্প যুগের প্রথম দিকে, সময় মূলত স্থানীয় ছিল। প্রতিটি কারখানা এবং একটি ক্লক টাওয়ার-সহ প্রতিটি শহর তার নিজস্ব সময় নির্ধারণ করত। কোনও সর্বসম্মত সময় নির্ধারণের ব্যবস্থা ছিল না। এর কোনও প্রয়োজনও ছিল না। সেই প্রয়োজনীয়তা প্রথম দেখা দেয় ১৯ শতকে। এর কারণ হল, রেল স্টিমার এবং টেলিগ্রাফের মত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের কারণে বিশ্ব আরও আন্তঃসংযুক্ত হয়ে ওঠে। ভ্যানেসা ওগল দ্য গ্লোবাল হিস্ট্রি অফ টাইমে (১৮৭০-১৯৫০) লিখেছেন, 'সর্বজনীন এবং অভিন্ন সময়, একটি আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। মানুষ, পণ্য এবং ধারণার নির্বিঘ্ন প্রবাহের অনুমতির জন্য এটা প্রয়োজন ছিল। দশমিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে অভিন্ন ওজন এবং পরিমাপের মত অভিন্ন সময়ের সামঞ্জস্য স্থাপন এবং পণ্য ও বিনিময়ের অনুমতি জরুরি হয়ে পড়েছিল।' তবে স্থানীয় সময় থেকে বৈশ্বিক সময়ে উত্তরণ সরাসরি ঘটেনি। প্রথমে জাতীয় সময়ের ধারণা এসেছে। যাকে জাতীয় ঐক্যের একটি উপায় এবং প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। সেই সঙ্গে উপনিবেশগুলো আরও ভালোভাবে পরিচালনার জন্য জাতীয় সময়ের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার বিস্তীর্ণ উপনিবেশে তথ্য ও পরিবহনের বিস্তারকে সহজ করতে জাতীয় সময়কে ব্যবহার করেছিল। এইভাবে, জাতীয় সময় বিশ্বব্যাপী সময় নির্ধারণের ভিত্তি হয়ে উঠেছিল। ফ্রান্সের প্যারিস মেরিডিয়ান, জার্মানির বার্লিন মেরিডিয়ান, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন মেরিডিয়ান এবং ব্রিটিশদের গ্রিনিচ মেরিডিয়ান ছিল। বিভিন্ন সাম্রাজ্যের স্বতন্ত্র প্রাইম মেরিডিয়ানগুলোতে তাদের নিজ নিজ মানচিত্রকে 0° দ্রাঘিমাংশ হিসেবে কল্পনা করা হয়। আর, সেই অনুযায়ী, তাদের উপনিবেশগুলোর সময় নির্ধারণ করেছিল ওই দেশগুলো।
কখন এবং কীভাবে জাতীয় সময় আন্তর্জাতিক সময়ের রূপ পেয়েছিল?
বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত প্রাইম মেরিডিয়ান তৈরির প্রথম প্রচেষ্টা ১৮৭০-এর দশকে শুরু হয়। যা জাহাজ এবং রেলের সময়সূচি তৈরির জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল। ১৮৮৩ সালে শিকাগোতে রেল রোড এক্সিকিউটিভদের একটি কনভেনশন হয়। সেখানে গ্রিনিচ মিন টাইমকে ভিত্তি করে উত্তর আমেরিকার পাঁচটি অঞ্চলে সময় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। পরের বছর, ২৬ দেশের প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটন ডিসিতে ইন্টারন্যাশনাল মেরিডিয়ান কনফারেন্সে মিলিত হন। আর, বিভিন্ন দেশের আলাদা সময়ের বদলে নির্দিষ্ট একটা সময় মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু, কোন সময় মেনে নেওয়া হবে, তা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ ছিল। শেষে গ্রিনিচ মানমন্দিরের সময়কে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওগল উল্লেখ করেছেন যে ভারতে, গ্রিনিচ মিন টাইম মেনে নিতে জাতীয়তাবাদীরা রাজি ছিলেন না। দুটি বিশ্বযুদ্ধর শেষে গ্রিনিচ মেরিডিয়ান মেনে নিতে সকলেই রাজি হন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে, IERS রেফারেন্স মেরিডিয়ান গৃহীত হয়েছে। যার কেন্দ্রস্থল পুরোনো গ্রিনিচ মেরিডিয়ান থেকে ১০২ মিটার দূরে।
আরও পড়ুন- উত্তর কোরিয়ার ভবিষ্যৎ নেত্রী কিম জু অ্যা? তালিম দিচ্ছেন খোদ কিম জং উন
উজ্জয়িনী সম্পর্কে দাবির ভিত্তি কী?
মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উজ্জয়িনীকে ৩০০ বছর আগের প্রাইম মেরিডিয়ান বলে উল্লেখ করেছেন। যাইহোক, সেই সময়ে সর্বজন স্বীকৃত কোনও প্রাইম মেরিডিয়ান ছিল না। যাইহোক, প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতের বিস্ময়কর কৃতিত্বই যাদবের দাবির ভিত্তি। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সময় নির্ধারণের ভাবনা এসেছে চতুর্থ শতাব্দীতে সংস্কৃত গ্রন্থ সূর্য সিদ্ধান্ত থেকে। যা সেই সময়ের বিচারে একটি অবিশ্বাস্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতি। টলেমির জিওগ্রাফিয়ার কয়েক শতাব্দী আগেই ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান, রোহিতক (আধুনিক রোহতক) এবং অবন্তী (আধুনিক উজ্জয়িনী) শহরগুলোর মধ্যে দিয়ে যাওয়া একটি মূল সময়রেখা বা প্রাইম মেরিডিয়ানের বর্ণনা করেছিল। এইভাবে, ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ঐতিহ্যে উজ্জয়িনী সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। কিছু আধুনিক পণ্ডিত তাই উজ্জয়িনীকে ভারতের গ্রিনিচ বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও ভারতীয় সময় বর্তমানে মির্জাপুরের সময়ের ভিত্তিতে চলে। তবে, সময় নির্ধারণের চেষ্টা এদেশেও নেহাত কম ঘটেনি। ১৭১৯ সালে, জয়পুরের রাজা সওয়াই জয় সিং শহরে একটি বিখ্যাত মানমন্দিরও তৈরি করেছিলেন।