বৃহস্পতিবার, জম্মু ও কাশ্মীর সরকার তিন দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো মহরমের মিছিলের অনুমতি দেওয়ার পরে হাজার হাজার শিয়া সম্প্রদায়ের শোকার্ত মানুষ শ্রীনগরের কেন্দ্রস্থলে হাঁটলেন। এবছরের ১৯ জুলাই শুরু হয়ে হয়েছে ইসলামি বছরের প্রথম মাস। তারই মধ্যে মহরমের মিছিলের অনুমতি প্রশাসন দেওয়ায় খুশি শ্রীনগরবাসী। শুক্রবার দেশজুড়ে মহরম পালিত হয়েছে। মিছিল হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তার আগে বৃহস্পতিবার মহরমের মিছিলের অনুমতি দিয়ে প্রশাসন বুঝিয়ে দিয়েছে যে কাশ্মীর উপত্যকা শান্তির দুনিয়ায় ফিরছে।
ইমাম হোসেনের আত্মত্যাগ
বর্তমান ইরাকের কারবালার যুদ্ধে (৬৮০ খ্রিস্টাব্দে) শহিদ হয়েছিলেন নবি হজরত মহম্মদের নাতি ইমাম হোসেন। তাঁর আত্মত্যাগের স্মরণে সারা বিশ্বের শিয়া মুসলমানরা মহরমের মিছিল বের করেন। যদিও জম্মু-কাশ্মীরের ডোগরা শাসকরা মহরমের মিছিল নিষিদ্ধ করেছিল। শুধুমাত্র রাতে মিছিলের অনুমতি দিয়েছিল। আর বর্তমান কাশ্মীর প্রশাসন শ্রীনগরে মহরমের মিছিল করতে দেয়নি, কারণ জঙ্গিপনার দাপাদাপি।
ডোগরা জমানায়
১৯২০-এর দশকে, ডোগরা শাসকরা 'শিয়া-সুন্নি উত্তেজনা'র কথা উল্লেখ করে মহরমের মিছিলগুলো সূর্যোদয়ের আগে গুটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। ১৯২৪ সালে, শোকার্ত শিয়ারা সেই আদেশ অমান্য করেছিল। আর, দিনের বেলায় মিছিল করেছিলেন। লেখক হাকিম সমীর হামদানির মতে, সুন্নিরাও সেই মিছিলেন তাঁদের সঙ্গে শামিল হয়েছিলেন। মিছিলটি পুরোনো শ্রীনগরের জাদিবল পাড়ার ইমামবাড়ায় গিয়ে নারওয়ারার সুন্নি মাজারে শেষ হয়েছিল।
মুসলিম স্বাধীনতা আন্দোলন
হামদানির মতে, 'সেই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন খাজা সাদউদ্দিন শাল। তিনি একজন বিশিষ্ট সুন্নি ব্যবসায়ী ছিলেন। এছাড়াও মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন শিয়া জায়গিরদার আগা সইদ হুসেন জালালি। এই মিছিল ডোগরা শাসনের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।' শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন ডোগরা শাসকদের কাছে আবেদন করার পর শিয়া ব্যবসায়ী হাজি কালু, শিয়া ধর্মগুরু ইফতিকার হুসেন আনসারির পরিবার এবং বুদগামের আগা পরিবারের মতো নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের মিছিল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
শিয়া ও সুন্নি উভয়ই
শ্রীনগরে মহরমের মিছিল ঐতিহ্যগতভাবে নামচাবল থেকে শুরু হয় এবং পুরোনো শহরের জাদিবলে শেষ হয়। ডোগরা শাসনের জমানায় কাশ্মীরের অন্যতম নেতা শেখ মহম্মদ আবদুল্লাহ জোর দিয়েছিলেন যে ১০তম মহরমের মূল মিছিলটি শ্রীনগর শহরের কেন্দ্রস্থলে আবি গুজার থেকে শুরু হওয়া উচিত। তা পুরোনো শহরের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং সেই মিছিল জাদিবলে শেষ হবে।
উঠে এলেন শেখ আবদুল্লা
শেখ আবদুল্লাহ আরও জোর দিয়ে জানিয়েছিলেন যে আনসারি পরিবার এবং বুদগামের আগা পরিবার বিকল্প বছরগুলোতে মিছিলের নেতৃত্ব দেবেন। আর, সেইবারের মিছিলটি শহরের কেন্দ্রস্থলে যাওয়ার সঙ্গেই ইফতিকার হোসেন আনসারির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের আব্বাস আনসারি বক্তৃতা করবেন। যেহেতু আনসারি এবং তাঁর ইত্তেহাদুল মুসলিমিন সুন্নিদের সঙ্গে পুনর্মিলনে বিশ্বাসী ছিলেন, তাই বিপুল সংখ্যক সুন্নি শোকাহতও সেই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন।
জঙ্গিবাদ শুরু হওয়ার পর
কয়েক দশক ধরে মহরমের মিছিল তাদের ঐতিহ্যবাহী পথে চলতে থাকে। ১৯৮৮ সালে সরকার এই অনুমতি প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, মহরম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া-উল-হকের মৃত্যুর দিনের সঙ্গে সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। কিন্তু, সরকারের সেই নির্দেশ কাশ্মীর উপত্যকায় বিক্ষোভের সূত্রপাত করেছিল। জঙ্গিদের দাপাদাপি শুরু হওয়ার পর, সরকার শ্রীনগরে প্রধান মহরম মিছিল নিষিদ্ধ করেছিল। যদিও শ্রীনগর শহরের শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় ছোট মিছিল বের করা অব্যাহত ছিল।
আরও পড়ুন- জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব কি এশিয়াতেই, কী বলছে আন্তর্জাতিক আবহাওয়া বিভাগ?
জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্ত
আব্বাস আনসারি এবং তার ছেলে মাসরুর আব্বাসের নেতৃত্বে শোকার্তরা সরকারি আদেশ অমান্য করেছিল। আর, অষ্টম মহরমে শ্রীনগর শহরের শহিদগঞ্জ এলাকা থেকে মিছিল বের করেছিল। পুলিশ তার বিরুদ্ধে কারফিউ এবং বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। কারণ, প্রশাসনের আশঙ্কা ছিল যে এই মিছিল বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থনে পরিণত হবে। ইত্তেহাদুল মুসলিমিন ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত কনফারেন্সের একটি অংশ। আব্বাস আনসারি নিজে ছিলেন হুরিয়তের চেয়ারম্যান। তাই সরকার আশঙ্কা করেছিল যে মহরমের মিছিলগুলো 'আজাদি-পন্থী বিক্ষোভ'-এ পরিণত হবে। গভর্নর জগমোহনের আমলে মহরমের মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও পরবর্তী সরকারগুলো, নিরাপত্তা সংস্থার পরামর্শে কাজ করেছিল। আর, এই কাশ্মীরে মহরমের মিছিলের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করেছিল।