লাদাখ সীমান্তে সংঘর্ষের ঘটনায় ভারতীয় জওয়ানদের মৃত্যুর খবর আসা শুরু হলে অনেকেই হয়তো এটা ভেবে স্বস্তি লাভ করেন যে চিনা সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে এই সংঘর্ষে কোনও গোলাগুলি চলে নি। গুলির আঘাতে প্রাণনাশের চেয়ে এই মৃত্যু নিঃসন্দেহে আরও পাশবিক, তবে এর ফলে এই আশাও জাগে যে যান্ত্রিক স্তরে যাবে না এই সংঘর্ষ, দুই পারমাণবিক ক্ষমতাধারী পড়শির খটাখটিতে ব্যবহার করা হবে না রাইফেল, হাউইটজার, রকেট, মিসাইল, এবং যুদ্ধবিমান।
উভয় পক্ষের সংঘর্ষের ইতিহাস দেখলে অবশ্য সেই আশায় ঠাণ্ডা জল পড়তে বাধ্য। শেষবার এই দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ বাঁধে নাথুলায়, ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কামান এবং যুদ্ধবিমান পর্যন্ত জল গড়ানোর আগে দুই বাহিনীর মধ্যে প্রবল হাতাহাতি হয়। এই লড়াইয়ে প্রাণ দেন ৮৮ জন ভারতীয় সৈন্য। ওদিকে মৃত্যু হয় ৩০০-র বেশি চিনা সৈনিকের।
সংঘর্ষের পূর্ববর্তী সময়ে কয়েক মাস বিবেচনা করে ভারত সিদ্ধান্ত নেয়, তিন থাক কাঁটাতার দিয়ে বেড়া দেওয়া হবে সীমান্তে। সেইমতো ২০ অগাস্ট, ১৯৬৭ সালে কাজ শুরু হয়।
তার তিনদিন পর, ২৩ অগাস্ট, সামরিক পোশাকে নাথুলার দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে আসে আন্দাজ ৭৫ জনের একটি চিনা বাহিনী, এবং সীমান্তে পৌঁছে থেমে যায়। তাঁর টুপিতে লাল তাপ্পি দ্বারা চিহ্নিত 'পলিটিকাল কমিসার', যিনি কিছুটা ইংরেজি জানতেন, একটি লাল বই খুলে সেখান থেকে কিছু স্লোগান পড়েন, যার সজোরে পুনরাবৃত্তি করে তাঁর সঙ্গী বাহিনী।
ভারতীয় সেনা চুপচাপ, সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, যাকে পরিভাষায় বলা হয় 'স্ট্যান্ডিং টু'। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরে যায় চৈনিক বাহিনী, কিন্তু কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ফের প্রতিবাদ জানাতে থাকে।
আরও পড়ুন: চিনের পেশিপ্রদর্শনের কারণ কী?
কাঁটাতার যেদিন আরও উন্নত 'কনসার্টিনা কয়েল'-এ পরিণত করা হচ্ছে, সেই ৫ সেপ্টেম্বর বচসা বাঁধে চিনের পলিটিকাল কমিসার এবং ভারতের স্থানীয় পদাতিক বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাজ সিংয়ের মধ্যে। এরপর সাময়িকভাবে বেড়া দেওয়ার কাজ বন্ধ করে দেয় ভারত।
তবে ৭ সেপ্টেম্বর ফের কাজ শুরু হতেই ছুটে আসে প্রায় ১০০ চিনা সৈনিক, এবং শুরু হয় হাতাহাতি। জাটদের হাতে ভালোরকম উত্তমমধ্যম হজম করে পাথর ছুড়তে শুরু করে চিনেরা। প্রত্যুত্তরে পাথর ছোড়ে ভারতও।
এরপর ১০ সেপ্টেম্বর ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে হুঁশিয়ারি জারি করে চিন। বার্তার মর্মার্থ: "চিন সরকার ভারত সরকারকে কড়াভাবে সাবধান করে দিচ্ছে: চিনের সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনী চিন-সিকিম সীমান্তে পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে। ভারতীয় সেনা যদি উস্কানিমূলক অনুপ্রবেশ বন্ধ না করে, তবে গুরুতর পরিণতির দায় বর্তাবে ভারত সরকারের ওপর।"
ভারতীয় কোর কম্যান্ডার আদেশ দিয়েছিলেন, ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে বেড়া দেওয়ার কাজ। সেদিন কাজ শুরু হওয়ার পর পলিটিকাল কমিসারের নেতৃত্বে ফের একবার প্রতিবাদ জানাতে আসে চিনা বাহিনী। তাদের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিং।
আরও পড়ুন: একটি রাস্তাই কি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় বিবাদের মূলে?
কথাবার্তার মাঝে আচমকাই গুলি চালায় চিনা পক্ষ, এবং আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান সিং।
কমান্ডিং অফিসার চোট পেয়েছেন দেখে চিনা পোস্ট আক্রমণ করে ভারতের পদাতিক বাহিনী, কিন্তু গুরুতর ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে তারা। মৃতদের মধ্যে ছিলেন দু'জন অফিসার, যাঁদের মরণোত্তর বীরত্বের সম্মানে ভূষিত করা হয়। অসুরক্ষিত, খোলা জায়গায় চিনা মেশিন গানের গুলিতে ধরাশায়ী হন বহু সৈনিক। জবাবে কামান চালায় ভারতীয় সেনা, এবং ধূলিসাৎ হয় কাছাকাছির মধ্যে সমস্ত চিনা পোস্ট। এই ভারী আঘাতে ভারতীয়দের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশি চিনা সৈনিক প্রাণ হারান।
ভারতীয়দের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় থতমত খেয়ে চিন হুমকি দেয়, যুদ্ধবিমান নিয়ে নামবে তারা। তাতেও ভারতীয়রা পিছু না হটায় চিনা সংবাদমাধ্যম শিনহুয়া এই ধরনের কোনও পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করে।
সামরিক বার্তা প্রেরণ করে ভারত এবার চিনকে লিখিত বার্তা পাঠায় ১২ সেপ্টেম্বর। তাতে প্রস্তাব দেওয়া হয়, সিকিম-তিব্বত সীমান্তে নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হোক, ১৩ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে। এই প্রস্তাব অস্বীকার করে চিন, কিন্তু ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোটের ওপর শান্তই থাকে পরিস্থিতি।
১৫ সেপ্টেম্বর অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সমেত নিহত ভারতীয় সৈনিকদের দেহ ফেরত দেয় চিন, এবং জানায় যে তারা এ কাজ করছে "ভারত-চিন বন্ধুত্ব বজায় রাখার" স্বার্থে।
এরপর ১ অক্টোবর ফের একবার চোলা নামক জায়গায় সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়, তবে চিনা বাহিনীকে ফের একবার পিছু হটতে বাধ্য করে ভারতীয় সেনা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন