সময়টা ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। মহাত্মা গান্ধী দিল্লির বিড়লা হাউসের প্রার্থনা মণ্ডপের দিকে হাঁটছিলেন। সেই সময় ৩৫ বছর বয়সি যুবক নাথুরাম গডসে তাঁর সামনে আসে। পকেট থেকে একটি পিস্তল বের করে। পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তিনটি গুলি ছোড়ে। যা গান্ধীর বুকে, পেটে এবং কুঁচকিতে আঘাত করেছিল। ১৫ মিনিটের মধ্যেই 'জাতির জনক' মারা যান। ঘটনাস্থলে থাকা সামরিক কর্মীরা গডসেকে আটক করেন। তাঁর পিস্তল ছিনিয়ে নেন। পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আগেই ঘাতককে জনতা মারধর করে। পরবর্তীকালে, এই ঘটনায় তুঘলক রোডের একটি থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। যা একটি এফআইআর হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়।
- ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন গান্ধীজি।
- ১৯৪৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, এই মামলার রাষ ঘোষিত হয়।
- ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর, নাথুরাম গডসে ও নারায়ণ আপ্তে-কে অম্বালা জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়।
গডসের বিচার
১৯৪৮ সালের মে মাসে দিল্লির লালকেল্লার বিশেষ আদালতে গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরাম গডসের বিচার শুরু হয়। এই স্মৃতিস্তম্ভটি আগে শেষ মুঘল সম্রাট, বাহাদুর শাহ জাফরের বিচারের স্থান ছিল। বাহাদুর শাহ জাফরকে বার্মায় নির্বাসিত করা হয়েছিল। প্রায় নয় দশক পরে, ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী বা আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সদস্যদের বিহার হয়েছিল এখানেই। সেখানেই হয় নাথুরাম গডসের বিচারও। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের বিচার বিভাগীয় শাখার প্রবীণ সদস্য স্পেশাল জজ আত্মা চরণের সামনে বিচার হয়। সরকারপক্ষের আইনজীবীদের নেতৃত্বে ছিলেন বোম্বাইয়ের তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল সিকে দফতরি। তিনি পরে ভারতের সলিসিটর জেনারেল। তারপরে ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল হন।
সরকারি খরচে পছন্দের আইনজীবী
এই মামলায় নারায়ণ আপ্তে ও বিনায়ক সাভারকর-সহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সঙ্গে গডসেকেও তার পছন্দের আইনজীবীর সাহায্য নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অশোককুমার পাণ্ডে তাঁর বই, 'কেন তারা গান্ধীকে হত্যা করেছে: মতাদর্শ ও ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন'-এ লিখেছেন, 'আইন তার নিজস্ব গতিপথ নিয়েছিল। যেখানে তাকে (গডসে) সরকারি খরচে আইনি সহায়তা সরবরাহ করা হয়েছিল। জেলে থাকাকালীন তার বেশিরভাগ ইচ্ছাই পূরণ করা হয়।' বিচারের দ্বিতীয় দিনে, গডসে স্বীকার করেছেন যে আটক থাকাকালীন সবাই তার সঙ্গে নাগরিকের মতই ব্যবহার করেছিল। পাণ্ডে এমনটাই জানিয়েছেন।
মামলার রাজসাক্ষী
১৯৪৮ সালের জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে বিশেষ আদালত ১৪৯ জন সাক্ষীর শুনানি শেষ করে। সরকারপক্ষ এই মামলায় ৪০৪টি নথি এবং ৮০টি সাবসটেনশিয়াল এভিডেন্স আদালতে পেশ করে। পঞ্জাব হাইকোর্টের তিন বিচারপতি বেঞ্চে গডসের আবেদনের শুনানি হয়। এই বেঞ্চের অংশ ছিলেন বিচারপতি জিডি খোসলা। তিনি জানান, শুনানির সময় সরকারপক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন দিগম্বর ব্যাজ। এই প্রসঙ্গে বিচারপতি খোসলা বলেন, 'ব্যাজ ওই মামলার একজন আসামি। হত্যার পরিকল্পনায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী বা ষড়যন্ত্রকারী।' বিচারপতি খোসলা তাঁর বই 'দ্য মার্ডার অফ দ্য মহাত্মা'-য় লিখেছেন, গ্রেফতারের পর ব্যাজ তাঁর অপরাধ স্বীকার করে নেয়। আর, রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়।
পঞ্জাব হাইকোর্টে গডসে
১৯৪৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, এই মামলার রাষ ঘোষিত হয়। গডসে, আপ্তে এবং আরও পাঁচ জনকে অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন বিচারক আত্মা চরণ। গডসে এবং আপ্তে-কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সাভারকর খালাস হয়ে যান। বিচারক ঘোষণা করেছিলেন যে দোষীরা তাঁর এই নির্দেশের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করতে পারবে। মামলার রায় ঘোষণার চার দিন পর সাজাপ্রাপ্তরা সবাই পঞ্জাব হাইকোর্টে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন জানায়। সেই সময় পঞ্জাব হাইকোর্ট পূর্ব পঞ্জাব হাইকোর্ট নামে পরিচিত ছিল। আর, এই আদালত ছিল সিমলায়। মজার বিষয় হল, সাজার বিরুদ্ধে আবেদনের পরিবর্তে গডসে তদন্তের বিরুদ্ধে আবেদন জানিয়েছিল। কারণ, তদন্তটা চলেছিল বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। যেখানে অভিযোগ করা হয়েছিল, গডসে একা নয়। এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে অনেকে জড়িত ছিল। রীতিমতো ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে গান্ধীজিকে।
পঞ্জাব হাইকোর্টে আবেদন
পঞ্জাব হাইকোর্টে বিচারপতি খোসলা, বিচারপতি এএন ভাণ্ডারি ও বিচারপতি আছরু রাম-এর বেঞ্চে মামলার শুনানি হয়। বিচার চলাকালীন, গডসে আইনজীবী নিয়ে চাননি। তিনি নিজের আবেদনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করার অনুমতি চান। আদালত তার আবেদন গ্রহণ করে। বিচারপতি খোসলা লিখেছেন, আদালতে বক্তৃতা করার সময়, ঘাতক তার অপরাধ নিয়ে অনুশোচনা করেনি। উলটে, 'নিজেকে নির্ভীক দেশপ্রেমিক এবং হিন্দু মতাদর্শের একজন উত্সাহী নায়ক' হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। এই ব্যাপারে বিচারপতি খোসলা লিখেছেন, 'বিস্মৃতিতে বিলীন হওয়ার আগে তার (নাথুরাম গডসে) প্রতিভা প্রদর্শনের এই সুযোগটি' চেয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ২১ জুন, পঞ্জাব হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের বাকি রায় বহাল রাখলেও দত্তাত্রেয় পারচুরে ও শংকর কিস্তায়্যারকে মুক্তি দিয়েছিল।
আরও পড়ুন- জলদস্যু মোকাবিলায় বিশ্বের ত্রাতা ভারত! ১৯ পাক মৎস্যজীবীকেও উদ্ধার
চূড়ান্ত আবেদন
দণ্ডিতরা প্রিভি কাউন্সিলের কাছে আবেদনের জন্য একটি বিশেষ ছুটি চেয়েছিল। ব্রিটিশ জমানায় প্রিভি কাউন্সিল ছিল সর্বোচ্চ আদালত। ১৯৫০ সালে তার বদলে চালু হয় সুপ্রিম কোর্ট। তবে, সাজাপ্রাপ্তদের সেই আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল। এরপর ভারতের গভর্নর জেনারেলও করুণার আবেদন প্রত্যাখ্যান করার পর গডসে এবং আপ্তের ফাঁসি নিশ্চিত হয়ে যায়। অবশ্য, গডসে নিজে ক্ষমাভিক্ষার আবেদন জানায়নি। তার মা-বাবা ছেলের জন্য আবেদন করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর, উভয়কেই অম্বালা জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়। (এই লেখার ইংরেজি কপি প্রথম ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।)