মাঝে মাঝে, সকৌতুকে, নাবিকেরা তাকে ধরে ফেলে ।/ বিশাল আলবাট্রস, সমুদ্রের বিহঙ্গপুঙ্গব,/ তিক্ত ফেনা পেরিয়ে যে চলে আসে মৃদুমন্দ তালে,/ জাহাজের সহযাত্রী, সঙ্গদাতা, পথের বান্ধব ।… শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা 'অ্যালবাট্রস', অনুবাদ: বুদ্ধদেব বসু।
অ্যালবাট্রস, সমুদ্রের এই বিহঙ্গপুঙ্গবের শারীরিক সম্পর্কে এসেছে পরিবেশ-বদলের বিচ্ছেদ-যোগ। এ নিয়েই একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে প্রোসিডিংস অফ দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি জার্নালে। অ্যালবাট্রস একগামিতার জন্য বিখ্যাত। এক যৌন সঙ্গীর সঙ্গে এরা কাটিয়ে দিতে পারে আজীবন। তাদের মনোগামিতে মানুষ লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়। বিচ্ছেদ যে একেবারে হয় না অ্যালবাট্রসের, তা ঠিক নয়। পুরনো তথ্যে তা মাত্র এক শতাংশ। যখন কোনও যুগল দেখে তারা সন্তানের জন্ম দিতে পারছে না, বা মিলিত হতে পারছে না ঠিক মতো, তখনই ডিভোর্স হয়, নচেৎ না। গবেষণা বলছে, সেই সরল সমীকরণের দিন গিয়েছে। এখন যৌনতার ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকলেও, অ্যালবাট্রসের মধ্যে বিচ্ছেদ হচ্ছে একের পর এক। এক শতাংশ থেকে তা বেড়ে পৌঁছে গিয়েছে আটে। আটে যে আটকে থাকবে না, তাও তো নয়। আর সেই ভেবেই বিজ্ঞানীরা আশঙ্কিত।
দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূমি থেকে ৪৮৩ কিলোমিটার দূরে, দক্ষিণ অ্যাটলান্টিকের ফকল্যান্ড আইল্যান্ডস, অ্যালবাট্রসদের বিচরণক্ষেত্র। কালো-খয়েরি ১৫ হাজার ৫০০ যুগলকে ১৫ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন গবেষকরা (২০০৩ সাল থেকে)। তাতেই ডিভোর্স-বৃদ্ধির ছবিটা ঝোড়ো হাওয়ার মতো ফুটে উঠেছে। কিন্তু কেন ডিভোর্স বাড়ছে অ্যালবাট্রসের?
কেন এত ডিভোর্স?
ড. ফ্রান্সিসকো ভেঞ্চুরা, গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক, দুটি কারণ দেখিয়েছেন এর। প্রথমত, দীর্ঘতর সময় দূরে দূরে থাকা, ঠিক সময়ে ফিরতে না পারা একে অপরের কাছে। কেন হচ্ছে এটা? ভেঞ্চুরা জানাচ্ছেন, সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পাখিদের খাবারের খোঁজে আগের চেয়ে অনেক বেশি দূরে চলে যেতে হচ্ছে। এতেই তারা ঠিক সময়ে ফিরতে ব্যর্থ হচ্ছে। টাইমিংয়ে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। ব্যাটে বলে হচ্ছে না। ফলে আউট হয়ে যাচ্ছে সম্পর্কটিই। মানে ফিরে আসার প্রতীক্ষায় হতাশ হয়ে নতুন কাউকে বেছে নিতে হচ্ছে কোনও অ্যালবাট্রসকে, সে যে তখন চরম মিলন-উম্মুখ! দ্বিতীয় কারণটি হল, খাবারের অভাবে যৌনতায় অস্বাচ্ছন্দ্য। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলেই তা হয়েছে। এতে করে যৌনক্রীড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। খারাপ পারফরম্যান্সের ফলে একে-অপরকে দোষারোপ, টানাপোড়েন, এবং ডেকে আনছে বিচ্ছেদের খাঁড়া। এর ফলে অ্যালবাট্রসের সংখ্যাও কমছে। ব্রিডিং পেয়ার বা যুগলের যে সংখ্যা ছিল ১৯৮০ সালে, তার অর্ধেকের কিছু বেশি দেখা গিয়েছে ২০১৭-এ।
অ্যালবাট্রসের সঙ্গে আরেকটু আলাপ
অ্যালবাট্রস বিশাল ডানার পাখি। পাখিদের মধ্যে এরই সবচেয়ে বড় ডানা, দৈর্ঘ্য ১২ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। আশ্চর্য ভাল উড়াল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই পাখি। সমুদ্রের উপর শয়ে শয়ে মাইল উড়ে যেতে পারে। কিন্তু খুব কম শক্তি খরচ করে। এই কৌশল রয়েছে এদের ডানায় লুকিয়ে। সমুদ্রের হাওয়ায় ওড়ার পর ডানা দুটিকে সম্পূর্ণ প্রসারিত করে আটকে দিতে পারে ঘাড়ে থাকা কলকব্জার মাধ্যমে। ফলে ডানা না নাড়িয়েই সমুদ্রের হাওয়ার স্রোতে ভাসতে ভাসতে তরঙ্গিত এরা উড়ে যায়, শক্তি এর ফলেই সামান্য খরচ হয়।
মিলন-মরসুমে এরা নিজেদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীদের কাছে ফিরে আসে। একবারে একটা ডিম এবং এক মরসুমেও একটা ডিম দেয় সাধারণত। ২২ রকমের অ্যালবাট্রসের খবর মিলেছে এ পর্যন্ত। মিডওয়ে আইল্যান্ডের উইসডম নামে লেস্যান অ্যালবাট্রস পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়সী পাখি। বয়স ৭০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। চ্যান্ডলার রবিনস নামে বিজ্ঞানী এই পাখির পায়ে ট্যাগ লাগিয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে, যাতে একে চোখে চোখে রাখা যায়। ট্যাগ লাগানো পাখিদের মধ্যে উইসডমই সবচেয়ে পুরনো।
আরও পড়ুন গত দেড়শো বছরে দুরন্ত উষ্ণতা, মহাবিনাশ কি আসন্ন?
দানবিক ডানার অ্যালবাট্রসের ঘরে ফেরার তাল কেটে দিয়েছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। সঙ্গী বা সঙ্গিনীর প্রতি তাই আর যৌন ভাবে সৎ থাকতে তারা পারছে না, সবটাই এর ফলে ঘেঁটে গিয়েছে। বংশবৃদ্ধিতে কত দূর পর্যন্ত প্রভাব ফেলবে এই বদল, সেই তথ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এমনিতেই বিজ্ঞানীদের অনেকেই বলছেন, এখন গ্লোবাল মাস এক্সটিঙ্কশন চলছে, মানে জীবের মহাবিনাশপর্ব। এর আগেও নাকি পাঁচ বার এমন হয়েছে। যার একটিতে হারিয়েছে মহান প্রাণী ডাইনোসোরাস। বিজ্ঞানীরা জীবস্রোতের বিভিন্ন প্রজাতির গাদা গাদা অবলুপ্তির প্রসঙ্গ তুলে বলছেন বর্তমানের বিনাশ-কথা।
পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য একে ঠান্ডা করতে হবে। অ্যালবাট্রসের যৌনতায় আঁচ যেন আর না বাড়ে!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন