ধরা যাক, অনেক দিন পর রাস্তায় বেরিয়ে সে দিন আপনার প্রবল খিদে পেয়ে গেল। ঢুকতে গেলেন একটি রেস্তরাঁয়। গেটে বিশাল আকৃতির প্রহরী হাত বাড়িয়ে-- পাসপোর্ট প্লিস। আপনি তো চমকে গেলেন-- এটা এয়ারপোর্ট নাকি! হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রহরী বড় বাক্যে বলল-- ভ্যাকসিন পাসপোর্ট প্লিজ। বুঝতে পারলেন এবার, কিন্তু আপনার কাছে তো বস্তুটি নেই, বাড়িতে রয়েছে মহার্ঘ্য সার্টিফিকেট, আলমারিতে ন্যাপথলিন দিয়ে রেখে দিয়েছেন। নেট থেকে নামানোও যায়, কিন্তু তাতে ঝক্কি আছে, এ দিকে পেটে ছুঁচোয় যে ডন মারছে! নাহ, কিছুই করার নেই, আপনার কাতর ডাকে, কাকুতিমিনতিতে কোনও কাজ হল না। শুধু একটি নয়, আরও কয়েকটি রেস্তরাঁ আপনাকে গেট থেকেই গেট-আউট করে দিল এর পর। বাধ্য হয়ে, নেট থেকে নাকানি-চোবানি খেয়ে ভ্যকসিন সার্টিফিকেট নামালেন। না-- এই পরিস্থিতিতে এ দেশকে পড়তে হচ্ছে না। এখানে পথবিপথে ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রমাণ দেখানোর নামমাত্র নিয়মও নেই।
কিন্তু বেশ কয়েকটি দেশে তা আছে। আর এতে ভ্যাকসিন নেওয়ার হারও নাকি চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। ল্যানসেট-এ প্রকাশিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্র সেটাই বলছে। ফ্রান্স, ইটালি, সুইজারল্যান্ডের মতো ছ'টি দেশে কোভিড পাস না থাকলে রেস্তরাঁ, মিউজিয়ামের মতো নানা জায়গায় প্রবেশ নিষেধ। নিষেধাজ্ঞা জারির ২০ দিন আগে থেকে নিষেধাজ্ঞার ৪০ দিন পর্যন্ত প্রতিষেধকের ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। দেখা গিয়েছে, ছ'টির মধ্যে যে দেশগুলোয় ভ্যাকসিনেশনের হার তলানিতে, কঠোরতায় প্রতিষেধক নেওয়ার হার ভালই বেড়েছে সেখানে।
ওমিক্রন ভাইরাসের দাপাদাপি যখন। ওমিক্রন-কালে এই ধরনের একটি গবেষণা যে দারুণ কাজে লাগবে, না বোঝার কিছু নেই। এইটি বুঝিয়ে দিয়েছে, সোজা আঙুলের বদলে আঙুল বাঁকা করলে কাজ হয় অনেক বেশি। এমন অনেকেই রয়েছেন হাজারো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে ভ্যাকসিন নিচ্ছেন না, ফলে তাঁরা কোভিডের সহজ শিকার হয়ে উঠতেই পারেন, হচ্ছেনও-- এই ধরনের ব্যবস্থায় তাঁরা সুড়সুড় করে সুচটি ফুটিয়ে নেবেন। যদিও আমাদের দেশে এমন কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ঔদার্যে আমরা যে অনেক আগেই নোবেল পেয়েছি!
কী দেখা গিয়েছে?
২০২১-এর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের ভ্যাকসিন-তথ্য ঘেঁটেছেন গবেষকরা। ছ'টি দেশ মানে-- কোভিড পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক থাকা ডেনমার্ক, ইজরায়েল, ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ড। গবেষকরা একটি মডেল তৈরি করেছেন তথ্য বুনে বুনে। দেখা গেল, কড়াকড়ির ফলে ছ'টি দেশের মধ্যে যেগুলিতে ভ্যাকসিনেশনের হার খুবই কম ছিল আগে, যেমন ফ্রান্স, সেখানে-- প্রতি ১০ লক্ষে ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৮২৩ জন বেশি ভ্য়াকসিন নিয়েছেন। ইজরায়েলে ১ লক্ষ ৪৩ হাজার ১৫১ জন, সুইজারল্যান্ডে ৬৪ হাজার ৯৫২ জন এবং ইটালিতে ৬৬ হাজার ৩৮২ জন বেশি প্রতিষেধকপ্রাপ্ত হয়েছেন। জার্মানিতে অবশ্য এই বৃদ্ধি দেখা যায়নি। কারণ, সেখানে ভ্যাকসিনেশনের হার ছিল রীতিমতো ভাল। বহু দিন ধরেই প্রতিষেধক জার্মানিতে বাধ্যতামূলক। ডেনমার্কেও সংখ্যাটা বাড়েনি, কারণ সেখানে নাকি প্রতিষেধকের অভাব ছিল।
আরও পড়ুন ভারতে বুস্টার ডোজ কত দূর, বুস্টারশক্তি কি রুখতে পারবে ওমিক্রন?
কাদের মধ্যে প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে?
ভ্যাকসিন পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক করায় ভ্যাকসিনেশনের হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে যুব সমাজে। বিশেষ করে যাঁদের বয়স তিরিশের নীচে। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যাঁদের কম বলে মনে করা হয়, এবং যাঁদের অনেকেই মনে করেন ভ্যাকসিন না নিলেও কিচ্ছুটি হবে না। এখানে বলে নিই, সুইজারল্যান্ডে যখন ভ্যাকসিন-পাসপোর্ট প্রথম পাব-নাইট ক্লাব, বড় কোনও অনুষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করা হয়, তখন কুড়ির কোঠায় থাকা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভ্যাকসিন নেওয়ার ধুম পড়ে গিয়েছিল।
এখনও অনেককেই বলতে শুনি, কী হবে ভ্যাকসিন নিয়ে। আমার ভাই কোভিড হবেই না। তার পর তিনিই যখন করোনায় আক্রান্ত-- কী ভুল করেছি বাবা ভ্যাকসিন না নিয়ে। হায় হায়! অসীম অপরাধ বোধে তখন তাঁর মাথা ঘুরছে, বাঁচবেন কিনা জানেন না, অক্সিজেন খুঁজছেন! ফলে সরকার উদার হতেই পারে, পারেই… কিন্তু ভ্যাকসিনে উদাসীন হয়ে নিজের কাম তামাম করবেন কেন! কেন!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন