Advertisment

Explained: আরও পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশনের প্রতিশ্রুতি মোদীর, সব গ্রাহকেরই কি লাভ হবে?

ভর্তুকি ইস্যুতে পিছু হঠল বিজেপি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
PM Modi in MP

রবিবার ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে সিওনিতে একটি জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন। (পিটিআই ছবি)

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন (এনএফএসএ), ২০১৩-এর অধীনে কেন্দ্রের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য প্রকল্পের মেয়াদ, 'আগামী পাঁচ বছরের জন্য' বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। গত সপ্তাহান্তে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে নির্বাচনী সমাবেশে তিনি এই কথা জানান। গরিবকল্যাণ অন্ন-যোজনায় (পিএম-জিকেওয়াই) মহামারী-সময়ের ত্রাণব্যবস্থার অধীনে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এনএফএসএ-এর সমস্ত সুবিধাভোগীদের জন্য অতিরিক্ত পাঁচ কেজি খাদ্যশস্য বিনামূল্যে সরবরাহ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তা বন্ধ করা হয়। তবে এনএফএসএ-এর অধীনে সরবরাহ করা ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য প্রায় ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত বিনামূল্যেই বিতরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে এই বিনামূল্যে শস্য সরবরাহ আরও পাঁচ বছর অব্যাহত থাকবে। এতে কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের উপকার হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে বিজেপি তার লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে ব্যবহার করতে পারে। যদিও এই প্রধানমন্ত্রীই এর আগে অন্যান্য দল যেভাবে ভোটারদের 'বিনামূল্যে' এবং 'ভর্তুকি' দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল, তাকে 'ফ্রিবি' এবং 'রেওয়াদি' বলে উপহাস করেছিলেন।

Advertisment

পিএম-জিকেওয়াই কী?
পিএম-জিকেওয়াই ২০২০ সালের এপ্রিলে চালু হয়েছিল। কোভিড-১৯ অতিমারীর আঘাতে যাবতীয় অর্থনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে এই প্রকল্পের অধীনে এনএফএসের সমস্ত সুবিধাভোগীদের বিনামূল্যে প্রতিমাসে ৫ কেজি খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হয়েছিল। এই শস্য তাঁরা ত্রাণ আইনের অধীনে পাওয়া ৫ কেজি ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্যের পাশাপাশি পেয়েছিলেন। দেশ লকডাউনে যাওয়ার দু'দিন পরে, ২০২০ সালের ২৬ মার্চ, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, পূর্বে ঘোষিত ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার কোভিড ত্রাণ প্যাকেজের একটি অংশ হিসেবে এই প্রকল্প শুরু করার কথা জানান। তবে, প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে তিন মাসের (২০২০ সালের এপ্রিল, মে এবং জুন মাস) জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর ২০২০ সালের ৮ জুলাই, এই প্রকল্প ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, আরও পাঁচ মাসের জন্য বাড়ানো হয়। এপ্রিল মাসে কোভিডের ভয়ংকর দ্বিতীয় (ডেল্টা) তরঙ্গ আঘাত হানার পর ২০২১ সালে মোদী সরকার পিএম-জিকেওয়াই প্রকল্প পুনরায় চালু করে। আর, ২০২১ সালের মে এবং জুনে এই প্রকল্প তৃতীয় ধাপে চালু হয়।

বারবার বন্ধ আর চালু হওয়া
পরবর্তীকালে এই প্রকল্প ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ততক্ষণে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ কমে গিয়েছিল। আর, সবকিছু ফের স্বাভাবিক করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর, সরকার পিএম-জিকেওয়াই-এর পঞ্চম পর্যায়ের কথা ঘোষণা করে। যা ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ এবং পঞ্জাবের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কারণে সেই ঘোষণা করা হয়েছিল বলেই মনে করা হয়। এরপর নির্বাচনের ফলাফল ২০২২ সালের মার্চে ঘোষিত হয়। কিন্তু, সরকার ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের একটি ষষ্ঠ ধাপ অনুমোদন করে। তারপরে, ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই প্রকল্প সমাপ্ত হয়। এরপর, গুজরাত ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সরকার পিএম-জিকেওয়াইয়ের ৭ম পর্ব ঘোষণা করে। যার মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। অবশেষে, ২০২২-এর ২৪ ডিসেম্বর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা পিএম-জিকেওয়াই বন্ধ করার কথা জানায়। আর, ২০২৩ সালের জন্য এনএফএসএ-র অধীনে যোগ্য সুবিধাভোগীদের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

আরও পড়ুন Explained: কুষ্টিয়ায় ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর অসামান্য বীরত্ব, ‘পিপ্পা’-য় গরিবপুরের লড়াইয়েরও স্মৃতিতর্পণ

এনএফএসএ কী?
এনএফএসএ, ইউপিএ-২ সরকারের চালু করা একটা প্রকল্প। যা ২০১৩ সালের ৫ জুলাই কার্যকর হয়েছিল। এই আইন লক্ষ্যযুক্ত পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (টিপিডিএস)-এর অধীনে 'সাশ্রয়ী মূল্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্পন্ন খাবারের' নিশ্চয়তা নিশ্চিত করেছে। শহুরে এবং দেশের গ্রামীণ জনসংখ্যার ৭৫% এই প্রকল্পের দ্বারা উপকৃত হয়েছে। সব মিলিয়ে এনএফএসএর অধীনে রয়েছেন দেশের মোট জনগণের প্রায় ৬৭.৫%। এই আইনে, একটি রাজ্যের গ্রামীণ এবং শহুরে এলাকায় ব্যক্তির সংখ্যা গণনা করা হয়। জনসংখ্যার অনুমানের ভিত্তিতে প্রাসঙ্গিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ প্রকাশিত আদমশুমারি অনুযায়ী (২০১১ সালে করা) প্রায় ৮১.৩৫ কোটি লোক এনএফএসএ প্রকল্পের আওতায় রয়েছেন।

কারা কতটা খাদ্যশস্য পাবেন
এনএফএসএ প্রকল্পের ভর্তুকি মূল্য তফসিল-১ এ নির্দিষ্ট করা আছে। যা সরকারি নির্দেশে পরিবর্তিত হতে পারে। ২০২২ সালের শেষ অবধি, এনএফএসএ সুবিধাভোগীরা যথাক্রমে চাল, গম, বাজরা প্রতিকেজি ৩ টাকা, ২ টাকা এবং ১ টাকায় পেয়েছেন। খাদ্যশস্যের অর্থনৈতিক ব্যয় এবং খাদ্য ভর্তুকি বিল ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও বছরের পর বছর ধরে এই দামগুলির পরিবর্তন হয়নি। এবছর থেকে, রেশন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হয়েছে। একজন সুবিধাভোগী কতটা পরিমাণ শস্য পাওয়ার অধিকারী, তা-ও আইনে নির্ধারিত আছে। যা সংসদের অনুমোদন ছাড়া পরিবর্তন করা যাবে না। এনএফএসএর অধীনে সুবিধাভোগী পরিবারের দুটি বিভাগ আছে- অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা (এএওয়াই) পরিবার এবং অগ্রাধিকার পরিবারগুলি (পিএইচএস)। পরিবারের সদস্য সংখ্যা নির্বিশেষে প্রতিটি এএওয়াই পরিবার প্রতিমাসে ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য পাওয়ার অধিকারী। পরিবারের সদস্যদের সংখ্যা অনুযায়ী পিএইচএসের প্রতিটি সদস্য এনএফএসএর অধীনে প্রতিমাসে ৫ কেজি খাদ্যশস্য পাওয়ার অধিকারী। সুতরাং, একটি পিএইচএস পরিবার যত বড় হবে, ওই পরিবার তত বেশি খাদ্যশস্য পাবে।

রেশনের জন্য সরকার কতটা ভর্তুকি দিচ্ছে?
খাদ্যশস্যের অর্থনৈতিক ব্যয়ের চারটি প্রধান উপাদান- শস্য সংগ্রহের ব্যয়, শস্য একসঙ্গে রাখার ব্যয়, অধিগ্রহণ ব্যয় এবং বিতরণ ব্যয়। বছরের পর বছর এই সব বেড়েছে। ২০১৩-১৪ সালে চালের ভর্তুকি মূল্য ছিল ২,৬১৫.৫১ টাকা প্রতি কুইন্টাল। ২০২২-২৩ সালে তা বেড়ে ৩,৬৭০.০৪ টাকা হয়েছে। গমের ভর্তুকির খরচ ২০১৩-১৪ সালে ছিল প্রতি কুইন্টাল ১,৯০৮.৩২ টাকা। তা বেড়ে ২০২২-২৩ সালে ২,৫৮৮.৭০ টাকা হয়েছে। সরকারের খাদ্য ভর্তুকি বিলও বেড়েছে। এটি ২০২১-২২ সালে ২,৮৬,৪৬৯.১১ কোটি টাকায় নেমে যাওয়ার আগে ২০২০-২১ সালে ৫,৪১,৩৩০.১৪ কোটি টাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। ২০২২-২৩ সালে, সরকার ২,০৬,৮৩১.০৯ কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়েছে। সঙ্গে বলেছে যে এনএফএসএর অধীনে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণের খরচ হবে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা। এই ক্যালেন্ডার বছরের শুরুতে, পিএম-জিকেওয়াইয়ে সরকারের ব্যয় প্রতিমাসে প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকা ছিল। প্রকল্পের সপ্তম পর্ব শেষ হওয়া পর্যন্ত ব্যয় ছিল প্রায় ৩.৯১ লক্ষ কোটি টাকা। সরকার ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর, এনএফএসএর অধীনে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ করার সিদ্ধান্তের ফলে রাজকোষের ওপর ১৩,৯০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। ২০২৩ ক্যালেন্ডার বছরের জন্য মোট খাদ্য নিরাপত্তা বিল প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা হবে বলে সরকার এখন মনে করছে।

এনএফএসএর (রেশনের) গ্রাহকরা কত টাকার সুবিধা পাচ্ছেন?
অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা (এএওয়াই) প্রকল্পের অধীনস্ত পরিবারগুলির জন্য (অর্থাৎ, যারা প্রতিমাসে ৩৫ কেজি খাদ্যশস্যের অধিকারী), সরকার ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের জন্য ৯৯.৭৫ লক্ষ টন (৭১.০৭ লক্ষ টন চাল এবং ২৮.৬৮ লক্ষ টন গম) বরাদ্দ করেছিল। এর অর্থ হল এএওয়াই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত পরিবারগুলি সমগ্র বছরের জন্য মোট ২,৭০৫ কোটি টাকা সঞ্চয় করবে বলে অনুমান করা যায়। একইভাবে, পিএইচএইচগুলির জন্য, সরকার ৪২৩.৮৬ লক্ষ টন খাদ্যশস্য (২৭২.৮ লক্ষ টন চাল, ১৪৪.৭৬ লক্ষ টন গম এবং ৬.৩ লক্ষ টন বাজরা শস্য) বরাদ্দ করেছে। যা সরকারি কোষাগারে বছরে একসঙ্গে প্রায় ১১,১৪২ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে। এনএফএসএ হল সংসদের একটি আইনের অধীনে অধিকার-ভিত্তিক প্রকল্প। আর পিএম-জিকেওয়াই হল এনএফএসএর আওতায় থাকা সুবিধাভোগীদের জন্য ঘোষিত একটি প্রকল্প।

আরও পড়ুন- জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কৌশল কী, কেন এটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

বিনামূল্যে রেশনের প্রকল্প কি নির্বাচনে বিজেপিকে উপকৃত করবে?
প্রধানমন্ত্রীর তাঁর নির্বাচনী সমাবেশে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর কথা বলেছেন। ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানায় চলতি মাসেই নির্বাচন হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই দরিদ্রদের জন্য বেশ কিছু খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্প রয়েছে। নতুন ঘোষণা আসন্ন লোকসভা এবং দেশের অন্যান্য নির্বাচনের জন্য একটি বার্তা হতে পারে। সেটা হল বিজেপির কল্যাণমূলক রাজনীতির বার্তা। পিএম-জিকেওয়াই প্রকল্পের সময়সীমা সম্প্রসারণ উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের নির্বাচনে বিজেপিকে সাহায্য করেছে বলে মনে করা হয়। পরবর্তীকালে, বিজেপি গুজরাটেও খুব ভাল করেছে, কিন্তু হিমাচল প্রদেশে হেরেছে। কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে যে হিমাচলের প্রচারে কংগ্রেস বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এসব দেখে প্রধানমন্ত্রী এরপর বিজেপি বিরোধী দলগুলির দেওয়া 'ফ্রিবিজ'-এর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, নিজে উদার থেকেছেন। নিজেকে গরিবদের মসিহা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বিজেপি নেতাদের মতে, দল তথাকথিত 'রেওয়াদি'-র বিরোধী হিসেবে আর নিজেকে তুলে ধরতে চায় না।


COVID-19 Modi Government Ration card
Advertisment