জিডিপির হার ও অর্থনীতির হাল

ভারতের মত দেশে, যেখানে প্রতিবছর ন্যূনতম জিডিপি বৃদ্ধির হার বছরের পর বছর ধরে ৫.৬ শতাংশ থেকেছে এবং একই হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে, সেখানে যখন বৃদ্ধিহার এক অঙ্কে এসে দাঁড়ায় তখন তা অস্বাভাবিক ঠেকে।

ভারতের মত দেশে, যেখানে প্রতিবছর ন্যূনতম জিডিপি বৃদ্ধির হার বছরের পর বছর ধরে ৫.৬ শতাংশ থেকেছে এবং একই হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে, সেখানে যখন বৃদ্ধিহার এক অঙ্কে এসে দাঁড়ায় তখন তা অস্বাভাবিক ঠেকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Nominal GDP

এ বছরে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ

মঙ্গলবার জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর তাদের প্রথম আগাম অনুমান প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ভারতের প্রকৃত জাতীয় গড় উৎপাদন (জিডিপি) হবে ৪.৯৮ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবর্ষে, যে সময়ে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, তার পর থেকে এত খারাপ হাল আর হয়নি। সে বছর এই হার ছিল ৩.৮৯ শতাংশ। কিন্তু এর চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে। নমিনাল বৃদ্ধির হার অনুমান করা হচ্ছে ৭.৫৩ শতাংশ, যা ১৯৭৫-৭৬-এর পর একটি রেকর্ড। সে আর্থিক বর্ষে এই হার ছিল ৭.৩৫ শতাংশ। আরও একটি বিষয় আছে। ২০০২-০৩ অর্থ বর্ষের পর নমিনাল জিডিপি বৃদ্ধির হার এই প্রথম এক অঙ্কে এসে পৌঁছিয়েছে।

Advertisment

নমিনাল জিডিপি ও প্রকৃত জিডিপি

জিডিপি হল কোনও একটি নির্দিষ্ট বছরে সমস্ত পণ্য ও পরিষেবার বাজার মূল্য, যার মধ্যে পণ্যের উপর ধার্য সমস্ত কর ও ভরতুকিও ধরা থাকে। বর্তমান দামের বাজারমূল্য হল নমিনাল জিডিপি। একটি নির্দিষ্ট ভিত্তিবর্ষে সমস্ত পণ্যের মোট মূল্য হল প্রকৃত জিডিপি।

সহজ করে বললে, নমিনাল জিডিপি থেকে মুদ্রাস্ফীতি বাদ দিলে প্রকৃত জিডিপি বেরিয়ে আসে। একটি নির্দিষ্ট বছরকালে পণ্য ও পরিসেবা কতটা বেড়েছে তারই হিসেব প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধি। অন্যদিকে নমিনাল জিডিপি বৃদ্ধি হল উৎপাদন ও দামবৃদ্ধির ফলে আয়বৃদ্ধির হিসেব।

Advertisment

কিন্তু নামমাত্র বৃদ্ধি আদৌ কি দরকার? আমরা যখন বৃদ্ধির কথা বলি, তখন কি প্রকৃত উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলি না?

সাধারণভাবে প্রকৃত বৃদ্ধির বিষয়টিই দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান অর্থবর্ষে নামমাত্র (নমিনাল) ও প্রকৃত (রিয়াল) জিডিপির মধ্যে ফারাক অস্বাভাবিক, মাত্র ২.৬ পয়েন্ট। ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে এই হার ছিল ২.৫ শতাংশ। কিন্তু এ বছরে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ, যার অর্থ নমিনাল বৃদ্ধির হার ১০.৫ শতাংশ।

২০১৯-২০ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হবে, এমন আশঙ্কাতেই শেষ হচ্ছে না। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি, অর্থাৎ অর্থনীতিতে উৎপাদিত পণ্য ও পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির হারও মাত্র ২.৬ শতাংশ। সরল করে বললে, উৎপাদকরা বেশি উৎপাদনের মাধ্যমে বা বেশি দামের মাধ্যমে উপকৃত হননি।

গৃহস্থালি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে সাধারণত ব্যাপারটিকে ওপর ওপর দেখা হয়ে থাকে। গত বছরের তুলনায় তাদের আয় আনুপাতিক কত বেড়েছে। ভারতের মত দেশে, যেখানে প্রতিবছর ন্যূনতম জিডিপি বৃদ্ধির হার বছরের পর বছর ধরে ৫.৬ শতাংশ থেকেছে এবং একই হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে, সেখানে যখন বৃদ্ধিহার এক অঙ্কে এসে দাঁড়ায় তখন তা অস্বাভাবিক ঠেকে। নমিনাল জিডিপি বৃদ্ধি সাধারণত উন্নত পশ্চিম দেশগুলিতে ঘটে থাকে।

কর্পোরেট ও সরকারের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে?

এর আগে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলির আয় পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হত। যার অর্থ প্রতিবছর নামমাত্র বৃদ্ধির হার হত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। সে বৃদ্ধির হার যদি ৭ থকে ৮ শতাংশে নেমে আসে, তাহলে এবার এই দ্বিগুণ টার্নওভারের জন্য সময় লেগে যাবে ৯-১০ বছর। এর একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের সম্ভাবনা আছে। এতে কর্মীদের বেতন বাড়ার হার শ্লথ হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে লাভের বা আয়ের ক্ষেত্রে তত প্রভাব কোম্পানিগুলিকে ভোগ করতে হবে না।

সরকারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশি গুরুতর। ২০১৯-২০ বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ জিডিপি বৃদ্ধির হার ১২ শতাংশ অর্থাৎ ২১১.০১ লক্ষ কোটি হবে বলে অনুমানের কথা শুনিয়েছিলেন। তবে জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের অন্তিম অনুমান হল, ২০১৯-২০ সালে নমিনাল জিডিপি হবে মাত্র ২০৪.৪২ লক্ষ কোটি টাকা, যা বাজেট অনুমানের চেয়ে ৬,৫৮,৩৭৪ কোটি টাকা কম।

নমিনাল জিডিপি বৃদ্ধির হার বেশি হলে সরকারের ঋণ ব্যবস্থা পরিচালনা করতেও সুবিধে হয়। সে পরিস্থিতি পাল্টে যায় বৃদ্ধির হার কমে গেলে। এমনকি রাজ্য সরকারগুলির কাছেও নমিনাল জিডিপি বৃদ্ধির কম হার উদ্বেগের বিষয়, কারণ তাদের বাজেটে রাজস্ব বৃদ্ধির হার দু অঙ্কের হবে বলে ধরে নেওয়া থাকে।

কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে জিএসটি ক্ষতিপূরণের যে ফর্মুলা দিয়েছিল, সে ক্ষেত্রেও প্রতিশ্রুত রাজস্বের থেকে ১৪ শতাংশ কম পূরণ হচ্ছে। সে ক্ষেত্রেও, জিডিপি বৃদ্ধির হার যে ৭.৫ শতাংশে কমে আসবে, সে সম্ভাবনার কথা ভেবে এই হিসেব করা হয়নি।

তাহলে কি এক অঙ্কে জিডিপি বৃদ্ধিই নতুন দস্তুর হয়ে দাঁড়াল?

পর পর তিন বছর জিডিপি বৃদ্ধির হার এক অঙ্কে নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে ২০০-০১ থেকে ২০০২-০৩ সালে, যখন ক্ষমতায় ছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার। এই তিন বছরে নমিনাল বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৭.৬২ শতাংশ, ৮.২ শতাংশ ও ৭.৬৬ শতাংশ। এখন, যখন গত তিন মাসে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে চলেছে, সে সময়ে এমনটা হওয়ার কথা নয়।

বর্তমান প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার ৪.৯৮ শতাংশ- যা ওই তিন বছরের প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার (যথাক্রমে ৩.৮ শতাংশ, ৪.৮ শতাংশ ও ৩.৮ শতাংশ) থেকে বেশি। নরেন্দ্র মোদী সরকার যে ভাবে বৃদ্ধি ও লগ্নির ব্যাপারে ভূয়সী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে পরবর্তী আর্থিক বছরে ভাল ফল আশা করা যেতেই পারে।