Advertisment

'চূড়ান্ত' এনআরসি কেন চূড়ান্ত নয়?

নাগরিক আইন, ১৯৫৫ সালের হিসেব অনুসারে ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে যাঁরা আসামে প্রবেশ করেছেন তাঁদের ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে নথিবদ্ধ করতে হয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Assam NRC

ফাইল ছবি

আসামের এনআরসি কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি পরিবারভিত্তিক যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তার সঙ্গে একটি নোট সংযোজিত আকারে দিয়েছে তারা। সে নোটে বলা হয়েছে, এই তালিকায় যে নাম রয়েছে, তা পরে বাদ যেতে পারে এবং কোনওভাবেই এই তালিকা স্থায়ী নয়। এখনও পর্যন্ত এনআরসি-তে ৩.১১ কোটি নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, বাদ পড়েছে ১৯ লক্ষ নাম।

Advertisment

কোন ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত নাম বাদ যেতে পারে?

নোটে তিনটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে

১) এনআরসি কর্তৃপক্ষ যদি বুঝতে পারে যে যেসব তথ্য বা নথি দেওয়া হয়েছে তাতে গলদ রয়েছে

২) যদি দেখা যায় কোনও ব্যক্তি ঘোষিত বিদেশি (বা ১৯৬৬-৭১ সালের মধ্যের কোনও অভিবাসী যিনি ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে নথিবদ্ধ নন), অথবা কোনও ব্যক্তি যদি ডি ভোটার হন বা কোনও ডি ভোটারের উত্তরাধিকারী হন।

৩) ফরেনার্স ট্রাইবুনাল যদি কোনও ব্যক্তিকে বিদেশি বলে ঘোষণা করে।

আরও পড়ুন, ভারতীয় নাগরিক কারা? কীভাবে তা স্থির করা হয়?

ডি ভোটার বা ঘোষিত বিদেশি কারা?

১৯৯৭ সালে আসামে ডি ভোটার পদ্ধতি চালু হয়। যাঁরা ভেরিফিকেশনের সময়ে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেননি, তাঁদের ডি ভোটার বলে চিহ্নিত করা হয়।

আসামের ১০০ ফরেনার্স ট্রাইবুনালের যে কোনও একটি কোনও ব্যক্তিকে ঘোষিত বিদেশি বলে চিহ্নিত করতে পারে। ফরেনার্স ট্রাইবুনাল একটি আধা বিচারবিভাগীয় সংস্থা যারা ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইন অনুসারে কোনও ব্যক্তি বিদেশি কিনা, তা চিহ্নিত করতে পারে।

নাগরিক আইন, ১৯৫৫ সালের হিসেব অনুসারে ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে যাঁরা আসামে প্রবেশ করেছেন তাঁদের ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে নথিবদ্ধ করতে হয়। এঁদের ভোটাধিকার নেই, কিন্তু সব রকমের নাগরিক অধিকার রয়েছে। এই নাগরিক অধিকার তাঁরা ১০ বছর সময়কাল পর্যন্ত ভোগ করতে পারেন। এনআরসি নোটে বলা হয়েছে, ১৯৬৬ থেকে ৭১ সালের মধ্যে যাঁরা আসামে প্রবেশ করেছেন কিন্তু নিজেদের নথিবদ্ধ করাননি, তাঁরা বাদ পড়বেন।

এরকম ব্যক্তি আদৌ এনআরসি তালিকায় অন্তর্ভু্ক্ত হতে পারবে কী ভাবে?

এমন অভিযোগ উঠেছে যে ঘোষিত বিদেশিরা চূড়ান্ত এনআরসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আসামে নাগরিকত্ব নিয়ে সমান্তরাল বিভিন্ন প্রক্রিয়া চালু থেকেছে, এবং এনআরসি প্রক্রিয়া সেই ডেটাবেসগুলির মধ্যে কোনও সংহতিকরণ ছাড়াই চলেছে। একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেস এবার তৈরি হচ্ছে, যা ইলেক্ট্রনিক ফরেনার্স ট্রাইবুনালের অংশও বটে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সমান্তরাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে (যেমন ফরেনার্স ট্রাইবুনাল, বর্ডার পুলিশের রেফারেন্স এবং এনআরসি) যাঁদের সন্দেহভাজন বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তাঁদের নাম একসঙ্গে লিপিবদ্ধ থাকবে এবং তাঁদের বায়োমেট্রিকও সেখানে রক্ষিত থাকবে।

আরও পড়ুন, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল কী ভাবে কাজ করে

আরেকটা সম্ভাবনাও রয়েছে। কোনও ব্যক্তি যদি ফরেনার্স ট্রাইবুনালে যে সব নথি পেশ করেছেন, তা ট্রাইবুনাল যথোপযুক্ত বলে মনে করেনি, কিন্তু সেই একই নথি এনআরসি কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ফরেনার্স ট্রাইবুনালে বিদেশি ঘোষিত অনেকেই আবার উচ্চতর আদালতে আবেদন করে ভারতীয় বলে ঘোষিত হয়েছেন। আবার ট্রাইবুনালের মামলায় অনেক সময়েই একপাক্ষিক ভাবে রায় দিয়েছে আদালত, যেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের সপক্ষে সওয়ালই করেননি। সেই ব্যক্তিরাই নথি জমা দিয়েছেন এনআরসি আধিকারিকদের কাছে।

একজন এনআরসি আধিকারিক জানিয়েছেন ফরেনার্স ট্রাইবুনাল এনআরসি-র তুলনায় উচ্চতর কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে বলেও দিয়েছে- "ঘোষিত বিদেশির ক্ষেত্রে তাঁর নাম এনআরসি-তে নাম আছে কিনা তাতে কিছু যায় আসে না।"

এ ছাড়া কি এনআরসি তালিকা থেকে নাম মুছে যাওয়ার আর কোনও কারণ রয়েছে?

রাজ্যের আধিকারিকরা বলছেন, এনআরসি অন্তর্ভুক্ত কোনও ব্যক্তির নামে রেফারেন্স আইনি ভাবে দেবার অধিকারী বর্ডার পুলিশ। তবে রাজ্য তা কাজে লাগাবে কিনা, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এক সরকারি আধিকারিক জানিয়েছেন, যদি সত্যিই যথেষ্ট কারণ থাকে, তাহলে বর্ডার পুলিশ রেফার করতেই পারে।

বর্ডার পুলিশের এই অধিকারের কথা উঠে এসেছে এক অসমিয়া চ্যানেলে হিমন্ত বিশ্বশর্মার এক সাক্ষাৎকারেও। সেখানে তিনি বলেছেন এনআরসি-তে নাম তোলার জন্য যারা লিগ্যাসি ডেটায় তছরুপ করেছে, তেমন সন্দেহভাজনদের নিয়ে তদন্ত করা উচিত।

এনআরসি-র পুনর্মূ্ল্যায়নের দাবি অনেকেই তুলেছেন, তেমনটা কি সম্ভব?

ওই সাক্ষাৎকারে হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন, "সরকারের উচিত, আসু এবং আসাম পাবলিক ওয়ার্কস, যারা এনআরসি মামলার প্রথম আবেদনকারী ছিল, তাদের সঙ্গে একযোগে সুপ্রিম কোর্টে এনআরসি পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করা।" আসাম পাবলিক ওয়ার্কসের সভাপতি অভিজিত শর্মা জানিয়েছেন ১০০ শতাংশ পুনর্মূল্যায়ন দাবি করে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন।

আরও পড়ুন, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা আসলে কী? কোথা থেকে এল এই আইন?

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তথা অভিবাসন বিরোধী মঞ্চ (প্রবজন বিরোধী মঞ্চ)-এর আহ্বায়ক উপমন্যু হাজারিকা সম্প্রতি এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন, "এনআরসি প্রকাশিত হবার পর ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব বিধির ১০ নং ধারানুসারে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে যদি কোনও নাগরিকের নাম তালিকাভুক্ত হয়, তাহলে রেজিস্ট্রার জেনারেল বা তাঁর মনোনীত কেউ সে নাম বাদ দিতে পারেন... এই সংস্থান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে আধিকারিকের এনআরসি অন্তর্ভুক্ত নাম ফের মূল্যায়নের অধিকার রয়েছে, এ বিষয়ে তদন্ত হলে রেজিস্ট্রার জেনারেল পুনর্মূল্যায়ন করার অধিকারী হবেন।"

১০ নং ধারায় বলা হয়েছে, চূড়ান্ত এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত নাম কীভাবে বাদ যেতে পারে। তা করতে পারেন সিটিজেন রেজিস্ট্রেশনের রেজিস্ট্রার জেনারেল বা তাঁর দ্বারা অনুমোদিত কোনও আধিকারিক। এর মধ্যে রয়েছে ১) মৃত্যু, ২) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি নাগরিকত্ব আইনের ৮ ধারা বলে আর ভারতীয় নাগরিক না হন, ৩) আইনের ৯ নং ধারা বলে যদি ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রত্যাহৃত হয়, অথবা ৪) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা তাঁর পরিবার যে নথি দিয়েছেন, তা যদি বেঠিক হয়।

এনআরসি-র নোটেও নাম বাদ যাওয়ার কারণ হিসেবে ১০ নং ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তবে পুনর্মূল্যায়নের কথা সেখানে লেখা নেই।

 যে ১৯ লক্ষের নাম ইতিমধ্যেই বাদ গেছে তার কী হবে?

এঁরা ফরেনার্স ট্রাইবুনালে আবেদন করার সুযোগ পাবেন। প্রথম ধাপ হল এনআরসি কর্তৃপক্ষের বাদ পড়া সম্পর্কিত নির্দেশ সংগ্রহ করা- কিন্তু এতে কত সময় লাগবে তা স্পষ্ট নয়। সংশোধিত আইনানুসারে, কোনও ব্যক্তি আবেদন করার জন্য ১২০ দিন সময় পাবেন। যেদিন তিনি বাদ পড়া সম্পর্কিত নির্দেশ হাতে পাবেন, সেদিন থেকে এই দিন গোনা শুরু হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদি ১২০ দিনের মধ্যে আবেদন জমা না পড়ে, তাহলে ওই জেলার ডেপুটি কমিশনার ট্রাইবুনালে রেফারেন্স পাঠাবেন।

রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, তাঁরা জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইনি সহায়তা পাবেন। গুয়াহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী আমন ওয়াদুদ বলেছেন, "ফরেনার্স ট্রাইবুনালের কাছে বিপুল পরিমাণ নথি দেওয়া প্রয়োজন। সেটাই বড়় চ্যালেঞ্জ। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নথির সার্টিফায়েড কপি জোগাড় করা প্রথম বাধা। গরিব ও অশিক্ষিত মানুষ কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।" দরিদ্র মানুষদের জন্য নিখরচায় এ ব্যাপারে পরিষেবা দিচ্ছেন কিছু আইনজীবী। ওয়াদুদ নিজেও সেই দলে রয়েছেন।

বিজেপি ও তাদের আইনজীবীদের সংস্থা অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ সত্যিকারে ভারতীয় নাগরিকদের আইনি সহায়তা দেবার পরিকল্পনা করেছেন। বেশ কিছু এনজিও-ও আইনি সহায়তা দেবার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যাঁরা সচেতনতা প্রচারের জন্য বৈঠক করছেন।

Read the Full Story in English

Assam nrc
Advertisment