ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর, হত্যা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর দুই দেহরক্ষী বিয়ন্ত সিং এবং সতবন্ত সিং, শিখদের অপমান এবং অপারেশন চলাকালীন স্বর্ণ মন্দিরের অপবিত্রতার অভিযোগে প্রতিশোধ নিতে একেবারে সামনে থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে ৩০টিরও বেশি গুলি ছুড়েছিল। সেবছরের জুনেই হয়েছিল অপারেশন ব্লু স্টার। অর্থাৎ, অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান। তার জেরে হওয়া ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে গোটা দেশ শোকে ভেঙে পড়েছিল। ওই ঘটনার পর ভারতে দেখা সবচেয়ে জঘন্য সাম্প্রদায়িক হিংসা, শিক্ষা দাঙ্গা ঘটেছে। মাত্র তিন দিনে প্রায় ৩,৩৫০ শিখকে (সরকারি অনুমান) হত্যা করা হয়েছিল। তার মধ্যে দেশের রাজধানী দিল্লিতেই হত্যা করা হয়েছিল ২,৮০০ জন শিখকে। ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৩৯ বছর আগে।
দায়ভার নিয়েছিলেন
অপারেশন ব্লু স্টারে, ভারতীয় সেনাবাহিনী অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে প্রবেশ করেছিল। শিখদের পবিত্রতম মন্দির এই স্বর্ণমন্দির। সেখানে প্রাঙ্গনে লুকিয়ে ছিল সশস্ত্র জঙ্গিরা। তাদের বিরুদ্ধেই অভিযান চালানো হয়েছিল। লক্ষ্যে সফল হলেও, এই অভিযানে স্বর্ণমন্দিরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। প্রায় হাজারখানেক সাধারণ শিখ নাগরিক অভিযানে মারা গিয়েছিলেন। এই অভিযান বিশ্বব্যাপী শিখদেরকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তাঁদের অনেকেই অপারেশন ব্লু স্টারকে তাঁদের বিশ্বাসের ওপর আঘাত হিসেবে দেখেছিলেন। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি এই অভিযান চালানোর যাবতীয় দায়ভার মাথা পেতে নিয়েছিলেন।
পূর্বাভাস ছিল
ক্যাথরিন ফ্রাঙ্ক তাঁর ইন্দিরা ( ইন্দিরা: দ্য লাইফ অফ ইন্দিরা নেহরু গান্ধী, ২০০১)-এর জীবনীতে লিখেছেন, 'সবাই জানত যে তাঁর জীবনহানির হুমকি ছিল।' ব্লু স্টারের পরের দিন এবং পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে খোদ ইন্দিরা গান্ধীই সেসব কথা তাঁর পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে বলে গিয়েছেন। পুপুল জয়কার হলেন ইন্দিরা গান্ধীর একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি এবং তাঁর জীবনীকার (ইন্দিরা গান্ধী: একটি জীবনী, ২০০০)। তিনি লিখেছেন, 'নিজের মৃত্যুর ব্যাপারে চিন্তা করছেন, অতীতে আমি তাঁর (ইন্দিরা গান্ধী) মধ্যে কখনও এমন কোনও ভাবনাচিন্তা দেখিনি।' সেই কারণে বিস্মিত জয়কর যখন ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন তিনি এত ঘনঘন মৃত্যুর কথা বলছেন? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী কেবল বলেছিলেন, 'এটা কি অনিবার্য নয়?'
ইন্দিরা জেদ ধরেছিলেন
পূর্বাভাস সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধী জেদ ধরেছিলেন যে তিনি তাঁর নিরাপত্তায় শিখ রক্ষীদেরকেই রাখবেন। পূর্বাভাস অনুযায়ী, অপরারেশন ব্লু স্টারের পর ইন্দিরা গান্ধীর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল। তাঁকে বলা হয়েছিল, পুলিশ নয়। তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে সেনাবাহিনী। কিন্তু, ইন্দিরা গান্ধী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার জেরে, ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের কমান্ডোদের তাঁর সুরক্ষাদলে যুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা, বিশেষ করে তাঁর নাতি-নাতনি, রাহুল (তখন ১৪) এবং প্রিয়াঙ্কা (১২)-এর নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছিল।
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন
ইন্দিরার প্রধান সচিব পিসি আলেকজান্ডার পরে জয়করকে বলেছিলেন, 'তাঁর নাতি-নাতনিদের ক্ষতি হওয়ার ভয় তাঁর মধ্যে ছিল। বিশেষ করে অপহরণ করা বা আঘাত করার ভয়। জুন থেকে তিনি সেই নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন।'
যাইহোক, তিনি তাঁর সুরক্ষা থেকে শিখ জওয়ানদের অপসারণ করতে অস্বীকার করেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তার ১৯৮৪ সালের ১ নভেম্বরের সংস্করণে লিখেছে যে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর, ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে ইন্দিরাকে সুপারিশ করেছিলেন, 'গোয়েন্দা সংস্থাগুলির পাওয়া কিছু রিপোর্টের প্রেক্ষিতে' তাঁর (ইন্দিরা গান্ধী)-র নিরাপত্তায় কোনও শিখকে নিযুক্ত করা উচিত নয়। কিন্তু, ইন্দিরা গান্ধী সেই সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, 'আমরা কি ধর্মনিরপেক্ষ নই?' এমনটাই জয়করও লিখেছেন।
রক্ষীরাই তাঁকে গুলি করেছিল
তাঁকে তার নিজের বাড়িতে, তাঁর নিজের রক্ষীরাই গুলি করেছিল। ৩১ অক্টোবর সকাল ৯টা ১০ নাগাদ, ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লির ১, সফদরজং রোডে তাঁর সরকারি বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ১, আকবর রোডের পাশের বাংলোতে তাঁর ব্যক্তিগত অফিসের দিকে রওনা হন। তাঁর সঙ্গে ছিল কনস্টেবল নারায়ণ সিং এবং রামেশ্বর দয়াল, তাঁর ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান এবং তাঁর গৃহকর্মী নাথুরাম-সহ একটি ছোট দল ছিল। তিনি বাগানের পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ইন্দিরার নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘদিনের সদস্য, সাব-ইন্সপেক্টর বিয়ন্ত সিং এগিয়ে আসেন। কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কনস্টেবল সতবন্ত সিং। তিনি ছিলেন নতুন নিযুক্ত।
অভিবাদনের বদলে গুলি
জয়কার লিখেছেন, 'তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) হেসে অভিবাদন জানাতে গিয়েও তাঁর হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি দেখতে পান, যে বিয়ন্ত সিং তাঁকে অভিবাদন করার জন্য যে হাত তুলেছেন, সেই হাতে একটি রিভলভার ধরা আছে। বিয়ন্ত তাঁকে তিন ফুট দূর থেকে পেটে গুলি করেছিল।' জয়কার লিখেছেন এরপর সতবন্ত সিং ইন্দিরাকে তাঁর ৩০ রাউন্ড স্টেন গানের ক্লিপ খালি করার আগে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে আরও চারটি গুলি চালায়। এই গুলিবর্ষণ প্রায় ২৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল। এই সময় ইন্দিরা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন- কিছু নির্দিষ্ট জাতের ধান রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা ভারতের, কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী চালের দাম?
যেভাবে মৃত্যু হয়
ইন্দিরা গান্ধীর কনস্টেবল দয়াল বন্দুকধারীদের লক্ষ্য করে গুলি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু, তাঁর নিজের উরুতেই গুলি লাগে। গুলি করার পর বিয়ন্ত সিং এবং সতবন্ত সিং উভয়েই তাদের অস্ত্র মাটিতে ফেলে দেয়। বিয়ন্ত পঞ্জাব ভাষায় বলে, 'আমার যা করার ছিল তা করেছি। এখন আপনাদের যা করতে হবে, তা করুন।' দু'জনকেই এরপর দ্রুত নারায়ণ সিং এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত আইটিবিপি কমান্ডোরা ধরে ফেলে। ইন্দিরার মাটিতে লুটিয়ে পরা শরীরকে একটি সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে চাপিয়ে এইমস হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর মাথা ছিল পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর কোলে। চার ঘন্টা দীর্ঘ অস্ত্রোপচারের পরে, চিকিৎসকরা ব্যর্থ হন। দুপুর ২টো ২৩ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। হত্যার পরপরই হেফাজতে থাকা অবস্থায় বিয়ন্ত সিংকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সহ-ষড়যন্ত্রকারী কেহর সিং-সহ সতবন্তকে পাঁচ বছর পরে ফাঁসি দেওয়া হয়।
সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ায় দিল্লিতে
ইন্দিরার ছেলে রাজীব গান্ধী তাঁর মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরই পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফিরে আসেন। সেই সময় তিনি পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলেন। ৩১ অক্টোবর বিকেলে দিল্লিতে নামার আগেই কংগ্রেস পার্টি রাজীব গান্ধীকে ইন্দিরার উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নেয়। সেদিন সন্ধ্যা ৬টা ৩০ নাগাদ রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। রাত ১১টার কিছু পরেই তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। কিন্তু, রাজীব যখন তাঁর 'দুর্দশা এবং জ্ঞান'-এর মাধ্যমে এই 'দুঃখজনক অগ্নিপরীক্ষা' মোকাবিলার কথা বলেছিলেন, সেই সময় দেশের বিভিন্ন অংশ হিংসা ছড়ায়।
শিখদের নিশানা করা হয়েছিল।
কংগ্রেস সমর্থকদের একাংশ নিরপরাধ শিখদের নিশানা করে। হামলাকারীদের স্লোগান ছিল, 'খুন কা বদলা খুন সে লেঙ্গে'। জয়কার লিখেছেন, 'দিল্লিতে হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণ তিন দিন চলে। অবশেষে, সেনাবাহিনীকে ডাকা হয় এবং দিল্লি শহরে শান্তি ফেরে। এই ঘটনার তদন্তে কমিশন গঠিত হয়েছিল। কিন্তু, মাত্র কয়েকজন বাদে কাউকে কাঠগড়ায় তোলা সম্ভব হয়নি।'