মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা ফের একবার এক দেশ এক ভোটের কথাটা সামনে এনেছেন। সম্প্রতি আমেদাবাদে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশনার এমনটা চাইলেও নিকট ভবিষ্যতে এমনটা ঘটার সম্ভাবনা নেই।
সুনীল অরোরা বলেন, "হ্যাঁ, আমরা (একসঙ্গে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন) চাই। তবে এটা কোনও আমলাতান্ত্রিক বিবৃতি নয়, আমরা নীতিগতভাবে এরকমটা চাই।"
"তবে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলিকে একসঙ্গে আলোচনায় বসে সহমতে পৌঁছতে হবে। আইনে এমন সংশোধনী আনতে হবে যাতে নির্বাচনচক্র একসঙ্গে আনা যেতে পারে। তার আগে পর্যন্ত এ বিষয়টি সেমিনারের আলোচ্য বিষয় হিসেবে ভাল, কিন্তু অতি নিকট ভবিষ্যতে তেমনটা ঘটার সম্ভাবনা নেই।"
এক দেশ এক ভোট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজস্ব ধারণা, যে প্রসঙ্গ তিনি প্রায়ই উত্থাপন করে থাকেন। এবারের গ্রীষ্মে পুনর্নির্বাচিত হবার পরপরই সরকার এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেছে।
লোকসভা ও বিধানসভা ভোট একসঙ্গে হলে কী সুবিধা হবে?
এ নিয়ে দু পক্ষেরই যুক্তি রয়েছে।
একটা বড় যুক্তি হল, একবারে ভোট হয়ে গেলে খরচ অনেকটা কমবে।
এখন ভারতে যে কোনও সময়েই কোনও না কোনও ভোট হয়ে চলেছে। যদি ২০১৯ সালের কথাই ধরা হয়, এপ্রিল-মে মাসে সাত দফার লোকসভা ভোট এবং একই সঙ্গে অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িশা, অরুণাচল প্রদেশ এবং সিকিমের বিধানসভা ভোট, গত মাসে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার বিধানসভা ভোট, এবং ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হতে চলেছে ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা ভোট। এ ছাড়া বেশ কিছু রাজ্যে বিধানসভা ও লোকসভার উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, আরও কয়েকটি রাজ্যে তা হতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন ২৫ নভেম্বর। আগামী বছর দিল্লি ও বিহারের বিধানসভা ভোট।
যাঁর একসঙ্গে নির্বাচনের পক্ষে তাঁদের অন্যতম যুক্তি এর ফলে আদর্শ আচরণবিধি অনুসারে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বা নীতির ঘোষণা করার ক্ষেত্রে সমস্যা কমবে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, ভারতের মত বড় এবং ভিন্নতাপ্রবণ দেশে একসঙ্গে নির্বাচনের যে জটিলতা, তা সামলানো সম্ভব হবে না।
তাঁদের বক্তব্য এতে রসদ ও সরবরাহের সমস্যা হবেই। এরকম ভোটের জন্য লোকসভা ভোট যত পরিমাণ ইভিএম এবং ভিভিপিএটি মেশিন লাগবে, তার দ্বিগুণ পরিমাণ এ ধরনের মেশিন প্রয়োজন হবে।
একসঙ্গে ভোট হলে তাতে জাতীয় স্তরে শক্তিশালী দলগুলি আঞ্চলিক দলের তুলনায় বেশি সুবিধা পাবে এবং মেয়াদ সম্পূর্ণ হবার আগে কোনও সরকার ভেঙে পড়লে জটিলতা তৈরি হবে।
বিধানসভা বাদ দিলে এমন কি লোকসভাও ভেঙে যেতে পারে। ১৯৫২ সাল থেকে এ যাবৎ গঠিত ১৭টি লোকসভার মধ্যে ৭টি- ১৯৭১, ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৯১, ১৯৯৮ এবং ২০০৪-এর লোকসভা সময়ের আগেই ভেঙে গিয়েছে।
কিন্তু ভারতে তো একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট দিয়েই শুরু হয়েছিল?
১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সারা দেশে কংগ্রেস মসৃণভাবে জিতে ক্ষমতায় এসেছিল।
এই চক্র প্রথমবার ভেঙে পড়ে কেরালায়। ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে ইএমএস নামুদ্রিপাদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির সরকার ফেলে দেবার জন্য সেখানে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে কংগ্রেস। সে রাজ্যে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাসে। এর পরে ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেরালায় ভোট হয়।
কংগ্রেসের জনপ্রিয়ক খর্ব হতে শুরু করার পর ১৯৬৭ সালের ভোটে বিহার, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, মাদ্রাজ ও কেরালায় তারা ব্যাপক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। ক্ষমতায় আসে ভারতীয় ক্রান্তি দল, এসএসপি, পিএসপি, স্বতন্ত্র পার্টি, জনসংঘ এবং বিক্ষিব্ধ কংগ্রেসিদের নিয়ে গঠিত সংযুক্ত বিধায়ক দল সরকার।
দলবদল ও পাল্টা দলবদলের জেরে বিধানসভাগুলি ভেঙে পড়তে থাকে, এর ফলে কেন্দ্রের ভোট ও রাজ্যের ভোট একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হবার চক্রটি পৃথক হয়ে যায়।
এখন লোকসভা ভোটের সঙ্গে বিধানসভা ভোটপর্ব চলে মাত্র চারটি রাজ্যে। সে রাজ্যগুলি হল অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িশা, অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিম।
মূলত ১৯৮৫ সালের দলত্যাগ বিরোধী আইন এবং ৩৫৬ জারি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সৌজন্যে বিধানসভাগুলি এখন তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে।
তাহলে ফের একসঙ্গে ভোট করানোর দাবি উঠছে কেন?
নির্বাচন কমিশন ১৯৮৩ সালে বলেছিল এ রকম ব্যবস্থা কার্যকরী হতে পারে।
১৯৯৯ সালের মে মাসে বিচারপতি বি পি জীবন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল লোকসভা ও বিধানসভা ভোট একসঙ্গে করানোর পুরনো প্রক্রিয়ার আমাদের ফিরে যেতেই হবে।
২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধীর কাছে বিষয়টি তোলেন। কিন্তু বিষয়টি খুব একটা এগোয়নি।
২০১০ সালে এল কে আদবানি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করার পর ইন্টারনেটে পোস্ট করেন। তিনি লেখেন, এ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় খোলা মনে নিয়েছেন। এক বছর অন্তর ছোট সাধারণ নির্বাচন আমাদের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়, লিখেছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে ই এন সুদর্শন নাটচিয়াপ্পনের নেতৃত্বাধীন সংসদের একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি লোকসভা ও বিধানসভায় একসঙ্গে ভোটগ্রহণ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করে। সেখানে বলা হয়, এতে খরচ ব্যাপক কমবে, আদর্শ আচরণবিধির জেরে যে নীতিপঙ্গুত্ব তৈরি হয় তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহের উপর প্রভাব পড়বে এবং নির্বাচনের জন্য যে বহুল পরিমাণ লোকনিয়োগের চাপ, কমবে তাও।
একসঙ্গে ভোটের বিরোধী কারা?
কংগ্রেস কমিটিকে জানা এ প্রস্তাব অবাস্তব এবং অকার্যকরী।
তৃণমূল কংগ্রেসের বক্তব্য এ শুধু অগণতান্ত্রিকই নয়, অসাংবিধানিকও বটে।
সিপিএম বিষয়টির বাস্তব সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
বিরোধীদের আশঙ্কা, এর ফলে রাজ্যের ভোটে আঞ্চলিক যে উপাদানগুলি থাকে, তা হারিয়ে যেতে পারে একযোগে ভোট হলে এবং জাতীয় নেতা-নেত্রীদের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যেতে পারেন আঞ্চলিক নেতৃবর্গ।
অন্য দিক থেকে বিজেপির পক্ষে শুধু মোদীকে সামনে রেখে নির্বাচন লড়লেই তাদের কেল্লা অর্ধেক ফতে হয়ে যায়। স্বরাজ ইন্ডিয়ার সভাপতি যোগেন্দ্র যাদব বলেছেন এ আইডিয়া আসলে এক দেশ, এক বোট, এক নেতা, এক পার্টির ধারণা থেকে উদ্ভূত।