মৃত্যু, হাহাকার, বিভীষিকা…! রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে সঙ্গী কেবলই চোখের জল। দিশাহীন বিশ্বঅর্থনীতি। খাদ্যসংকট চরমে। তার মাঝেই যুদ্ধ থামার কোন নাম-গন্ধ নেই বললেই চলে। ভারত সহ সভ্য বিশ্বের একাধিক দেশ বার বার যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এক বছর ধরে চলা যুদ্ধে মৃত্যু ধ্বংস ছাড়া আরও কী..ই বা পেল পুতিনের দেশ?
গত এক বছর ধরে একটানা এই যুদ্ধ চলছে, এই মুহূর্তে যুদ্ধ শেষের কোন আভাসও মেলেনি। হাল ছাড়তে নারাজ দুপক্ষই। যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোন দেশই জেতেনি… যুদ্ধজয়ের আনন্দের স্বাদ পেতে মৃত্যু হয়েছে হাজার হাজার অসহায় মানুষের। বিপন্ন হয়েছে কত তাজা শৈশব। শহরের বুক চিঁড়ে গড়ে ওঠা সুন্দর সুন্দর বসতি গুলো তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়েছেন। পড়শি পোল্যাণ্ড সহ একাধিক দেশে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেঁচেছেন অজস্র মানুষ। জুটেছে বাস্ত্যচ্যুতের তকমা। প্রতিবেশী দেশে গিয়ে উদ্বাস্তু’র মত দিন যাপন করতে হয়েছে তাও অবিরাম চলছে যুদ্ধ….!
স্প্যানিশ-আমেরিকান দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানা বলেছেন, 'শুধু মৃতরাই দেখেছে যুদ্ধের সমাপ্তি'। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হল আজ। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা উপরোক্ত বক্তব্য থেকে ভালোভাবে বোঝা যায়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ইউক্রেনে তার 'বিশেষ সামরিক অভিযান' ঘোষণা করেন। তিনি তখন বলেছিলেন যে রাশিয়ার লক্ষ্য ইউক্রেন দখল করা নয়, বরং লক্ষ্য নিরস্ত্রীকরণ করা। জবাবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, "তারা আক্রমণ করলে আমরাও তাদের মোকাবেলা করব, আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেলেও হার স্বীকার করব না আমরা”।
এই যুদ্ধে ইউক্রেন ক্ষত-বিক্ষত হলেও ক্ষতি হয়েছে রাশিয়ারও। বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত। গত এক বছরে রাশিয়া ইউক্রেনের বড় বড় শহর ও বন্দর দখল করেছে। একই সঙ্গে পাল্টা হামলায় ইউক্রেনের সেনাবাহিনী আবারও বেশির ভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে। পশ্চিমী বিশ্বের অনুমান যুদ্ধে রাশিয়ার ১.৮০ লাখ এবং ইউক্রেনের ১ লাখ সেনা নিহত হয়েছেন। তবে ইউক্রেন দাবি করেছে যে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ পর্যন্ত ১লক্ষ ৪৫ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছে। তবে, ইউক্রেন নিজের দেশের সেনা মৃত্যুর বিষয়ে কোন তথ্য এখনও সামনে আনেনি।
রাষ্ট্রসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত ৮ হাজারের বেশি সাধারণ মানুষ মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ১৩ হাজারের বেশি। যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ শতাংশ মহিলা। এই যুদ্ধ একটি বিশাল ‘শরণার্থী সংকটের’ জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘ জানিয়েছে, প্রায় ৪ কোটি জনসংখ্যার ইউক্রেনের প্রায় ৮০ লাখ মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। জার্মানি, পোল্যান্ড, মলদোভার মতো দেশ ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছে।
কিয়েভ স্কুল অফ ইকোনমিক্সের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে সেই বছরেই ডিসেম্বর পর্যন্ত, রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনের $ 138 বিলিয়ন (11 লাখ কোটি টাকা) মূল্যের স্থাপত্য ধ্বংস হয়েছে। ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রুশ বোমা হামলা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দেড় লাখের বেশি আবাসিক ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।একইভাবে সারাদেশে তিন হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার কিছু কিছু আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ১৫০০ ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক স্থান এবং হাজার হাজার ক্রীড়াপ্রাঙ্গন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন : < প্রশাসন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’! থানায় খালিস্তানি সমর্থকদের বর্বোরোচিত তাণ্ডব, বন্দিকে মুক্তি পুলিশের >
যুদ্ধ ইউক্রেনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও পুরোপুরি ধ্বংস করেছে। রাশিয়ার হামলায় সেদেশের ১১০০টিরও বেশি হাসপাতাল ধুলোয় মিশে গিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশই গমের ঘাটতির মতো খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। বিশ্বব্যাংক গত বছর এক বিবৃতিতে বলে, যে ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী জিডিপি বৃদ্ধির হার ৩.২ শতাংশ ছুঁতে পারে, যা এখন ২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির হার ৬.৬% হবে বলে অনুমান করা হয়েছে।
পুতিন যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তখন তিনি আশা করেননি যে যুদ্ধ এত দিন চলবে। তিনি ভেবেছিলান যে রাশিয়ান সেনাবাহিনী মাত্র এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে ইউক্রেনের একটি বড় অংশ দখল করবে। কিন্তু, পশ্চিমী দেশগুলোর হস্তক্ষেপ ভ্লাদিমির পুতিনের সেই আশায় জল পড়েছে।
আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, তুরস্ক, সুইডেন, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং নরওয়ে ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সাহায্য করেছে। এর পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। রাশিয়াও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সম্ভবত সে কারণেই ভ্লাদিমির পুতিন অতীতে বেশ কয়েকবার ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় সম্মত হয়েছেন, কিন্তু ইউক্রেন এখন অনড় যে রাশিয়ান সেনাবাহিনী তার ভূখণ্ড ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আলোচনায় বসবে না জেলেন্সকির দেশ।