'ইন্ডিয়া আউট'- সোজা বাংলায় বললে, 'ভারত নিপাক যাও'। এটা ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুরের প্রচারের একটি স্লোগান। ১৭ নভেম্বর তিনি দ্বীপরাষ্ট্রের শাসনভার হাতে নেবেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই স্লোগানে নতুন কিছু নেই। গত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরেই মালদ্বীপে ভারত-বিরোধী মনোভাব বাড়ছে। ভারতের ব্যাপারে মালদ্বীপবাসীর অভিযোগের তালিকাও এখন বেশ লম্বা।
মনে রেখেছে মালদ্বীপ
তার মধ্যেও ৩৫ বছরের আগের এক ইতিহাস মালদ্বীপবাসী কিন্তু মনে রেখেছেন। সেই ইতিহাসের নাম, 'অপারেশন ক্যাকটাস'। যে অভিযানের মাধ্যমে সাড়ে তিন দশক আগে মালদ্বীপে অভ্যুত্থান রুখে দিয়েছিল ভারত। সময়টা ছিল ১৯৮৮ সাল। মালদ্বীপ বিশেষজ্ঞ ড. গুলবিন সুলতানা ২০২১ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন, 'মালদ্বীপে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য আছে। সেই অনুযায়ী তারা ভারতের বিরুদ্ধেও কথা বলে। ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের যা সমস্যা আছে, তা নিয়ে চিল-চিৎকার পর্যন্ত জুড়ে দেয়। কিন্তু, ওই অভিযানের কোনও সমালোচনা কোনও দল করে না। ১৯৮৮ সালে দ্বীপরাষ্ট্রে ভারত যেভাবে অভ্যুত্থান প্রতিরোধ করেছিল, আমরা তা ৩ এবং ৪ নভেম্বর স্মরণ করি।'
অভ্যুত্থানের চেষ্টা
মালদ্বীপ ভারতের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে। এর রাজধানী মালে ভারতের তিরুবনন্তপুরম থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে। ভারত মহাসাগরে ৯০,০০০ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে ছড়ানো প্রায় ১,২০০ নীচু প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপরাষ্ট্র। এখানকার মামুন আবদুল গাইয়ুমের জন্ম ১৯৩৭ সালে। তিনি ১৯৭৮ সালে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হন। সেই সময় মালদ্বীপে অর্থনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে ছিল। গাইয়ুম ৩০ বছর ধরে মালদ্বীপ শাসন করেন। কিন্তু, ১৯৮০-র দশকে, তাঁর শাসনে অসন্তুষ্ট মালদ্বীপবাসী তিনটি অভ্যুত্থান চালায়। তার মধ্যে একটি অভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৮০ সালে। দ্বিতীয়টি হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। আর, তৃতীয় অভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। ভারত যদি হস্তক্ষেপ না করত, তবে গাইয়ুমের শাসনে তৃতীয় বা শেষ অভ্যুত্থানটা নিশ্চিতরূপে সফল হত। এমনটাই দাবি করেন মালদ্বীপের বিশেষজ্ঞরা।
চক্রান্তকারী এবং হামলাকারী
১৯৮৮ সালের অভ্যুত্থানটি ছিল মালদ্বীপের ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ লুথুফি এবং আহমেদ 'সাগারু' নাসিরের মস্তিষ্কপ্রসূত। যা তামিল জঙ্গি সংগঠন, পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অফ তামিল ইলাম (PLOTE) সংগঠনের নেতা উমা মহেশ্বরন দ্বারা সমর্থিত। কয়েক মাস প্রস্তুতির পর, ৩ নভেম্বর ভোরে, ৮০ জন PLOTE হামলাকারী, লুথুফি এবং নাসির-সহ মালদ্বীপের কিছু স্থানীয় লোকজন কয়েকটি শ্রীলঙ্কান মালবাহী জাহাজে চেপে মালে পৌঁছেছিল। হামলাকারীদের কাছে ছিল ভারী মেশিনগান, একে-৪৭, গ্রেনেড এবং মর্টার। মালদ্বীপের সশস্ত্র বাহিনী এনএসএস-এর সদর দফতর-সহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো দখল করাই ছিল হামলাকারীদের উদ্দেশ্য। তারা আংশিকভাবে সফলও হয়েছিল। দুপুরের মধ্যেই মালের বেশিরভাগ অঞ্চল তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। সেই সময় প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম একটি নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
জড়িয়ে পড়ে ভারত
এই অভ্যুত্থানের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জরুরি বার্তা পৌঁছয়। মালদ্বীপের তৎকালীন হাইকমিশনার অরুণ ব্যানার্জি সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তাঁর নয়াদিল্লির বাড়িতে ঘুম থেকে উঠেছিলেন। সকাল ৯টা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সভাপতিত্বে সাউথ ব্লকে একটি সংকট কমিটির বৈঠক হয়। এরপরই ভারতীয় সেনা সদর দফতরকে সম্ভাব্য অভিযানের কথা জানানো হয়। আগ্রায়, ব্রিগেডিয়ার ফারুখ বুলসারার নেতৃত্বে ৫০তম প্যারাসুট ব্রিগেডকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছিল। ৬. প্যারা ব্রিগেডের কর্নেল সুভাষ সি জোশী এই অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন বলে ঠিক হয়। বিকেল ৩টে ৩০ নাগাদ, বিমানবাহিনীর ৪৪ স্কোয়াড্রন এবং প্যারাসুট ব্রিগেড নির্দেশের জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষায় ছিল। হাইকমিশনার জওয়ানদের গোটা ঘটনাটি বিস্তারিত জানাতে গিয়েছিলেন। অভিযানের নেতৃত্বে থাকা কর্নেল জোশী ২০২১ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, 'হাইকমিশনারকে দলে রাখার সুবিধা হল যে তিনি আমাদের ব্রিফিং রুমে একটি বই দিয়েছিলেন। যা আমাদের অনেক তথ্য দিয়েছে। এই তথ্য অত্যন্ত দরকারি ছিল। এটি একটি ট্যুরিস্ট গাইড বই। যা আপনি দিল্লির কনট প্লেসেও পেতে পারেন। ওই বইয়ের মাধ্যমেই আমরা মালে সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি।'
অভিযানে সাফল্য আসে
রাত সাড়ে ৯টার দিকে, ভারতীয় সৈন্য এবং হাইকমিশনার অরুণ ব্যানার্জিকে নিয়ে আগ্রা থেকে উড়ে যাওয়া দুটি ইলিউশিন (আইএল-৭৬) বিমান সরাসরি গিয়ে নামে মালদ্বীপের প্রধান বিমানবন্দরে। বিদ্রোহীদের ওপর দ্রুত এই অবতরণের প্রভাব পড়ে। এই অভিযানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ভারতীয় বায়ুসেনার প্যারাট্রুপার অশোক চোরদিয়া ২০১৮ সালে তাঁর 'অপারেশন ক্যাকটাস' বইয়ে লিখেছেন, 'হামলাকারীরা ভারতীয় জওয়ানদের সংখ্যা কত, সেই ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। তারা মনে করেছিল যে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সেনা দ্বীপরাষ্ট্রে পৌঁছেছে। ভয়ের চোটে তারা হামলা বন্ধ করে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।' গাইয়ুমকে উদ্ধারের জন্য মালে দ্বীপে পৌঁছনোর পর প্যারাট্রুপাররা বিমানবন্দরটিকে সুরক্ষিত করেছিল। এই সময় পালানোর জন্য লুথুফি এবং কিছু বিদ্রোহী একটি বাণিজ্যিক জাহাজ অপহরণ করে। নিশ্চিন্তে পালানোর জন্য তারা মালদ্বীপের পরিবহণ মন্ত্রী-সহ সাতজনকে পণবন্দি করে। কিছু বিদ্রোহীকে দ্বীপে রেখে দেওয়া হয়েছিল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া এবং লুথুফিরদের পালানোর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। অবশ্য তাতে লাভ হয়নি। সবাইকে বন্দি করা হয়। ৪ নভেম্বর, ভোর ৫টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট গাইয়ুমকে 'সুরক্ষিত করা' হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়।
সমুদ্রে তাড়া
ব্রিগেডিয়ার বুলসারার নির্দেশে, প্যারাট্রুপাররা পলায়নরত বিদ্রোহীদের জাহাজে গুলি চালায়। যার ফলে, জাহাজটির গতি ধীর হয়ে যায়। এরপর নৌবাহিনী জাহাজটিকে আটকায় এবং পণবন্দিদের উদ্ধার করে। ফ্রিগেট আইএনএস বেতওয়া (কোচি থেকে রওনা দিয়েছিল), এবং আইএনএস গোদাবরী (অস্ট্রেলিয়ায় বন্ধুত্বপূর্ণ সফর থেকে ফিরে রওনা দিয়েছিল) এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার আঞ্চলিক জলসীমায় প্রবেশের আগেই পলাতক বিদ্রোহীদের জাহাজটিকে আটকানোই ছিল নৌবাহিনীর লক্ষ্য। এরপর, ৫ নভেম্বর ভারতীয় জাহাজগুলি বিদ্রোহীদের জাহাজকে ঘিরে ফেলে। পালানোর পথ না-পেয়ে, বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাদের গ্রেফতার করে আইএনএস গোদাবরীতে নিয়ে যাওয়া হয়।
আরও পড়ুন- মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তা! বারে বারে ইডি-র সমন এড়ালে কী পরিণতি?
পরিশেষে
অভ্যুত্থানের চেষ্টা এবং বাধাদানের লড়াইয়ে ১৯ জন প্রাণ হারান। ৬৮ শ্রীলঙ্কান জঙ্গি এবং সাত জন মালদ্বীপবাসীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং মালদ্বীপে বিচার করা হয়। লুথুফি-সহ চার জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর অনুরোধে মৃত্যুদণ্ড রোধ করা হয়। ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা মালেতে ১৫ দিনেরও বেশি সময় ছিলেন। তাতেই, দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। এমনকী সদ্য প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত মুইজ্জুও এবার নির্বাচনে জয়লাভের পর তাঁর ভারত-বিরোধী বক্তৃতার ঝাঁঝ কমিয়েছেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তিন দিন পর তিনি ভারতীয় হাইকমিশনার মুনু মাহাওয়ারের সঙ্গে দেখা করেছেন। এই বৈঠকে, 'মালদ্বীপ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি'র ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।