কোভিডের মৃত্যুর যে খতিয়ান দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, তাতে হইচই পড়ে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, নানা দেশে মৃত্যুর যে সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে, তার সঙ্গে WHO-র জানানো সংখ্যায় আকাশ-পাতাল ফারাক। এই ফারাকটা ভারতের নিরিখে দেখতে গেলে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার জোগাড়। WHO-র হিসেব মানলে বলতে হবে, মহামারির প্রথম দু'বছরে ৯০ শতাংশ মৃত্যুই নথিভুক্ত করা হয়নি এ দেশে। ফলে হইচই তো হবেই।
WHO-র হিসেবে, ২০২০ এবং ২০২১ সালে কোভিড-সম্পর্কিত মৃত্যুর সংখ্যা ভারতে ৪৭ লক্ষ ৪০ হাজার ৮৯৪। যা অন্য সব দেশকে ছাপিয়ে অনেকটা বেশি। WHO-র সঙ্গে তুলনায় আমাদের সরকারি হিসেবটা ঠিক কী? সরকার বলছে, ২০২০-র ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১-এর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ৪ লক্ষ ৮১ হাজার ৪৮৬ জনের। অর্থাৎ কিনা সরকারের ডেটার চেয়ে WHO-র ডেটা ১০ গুণ বেশি। এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক। WHO-র ডেটাকে কার্যত গল্পকথা বলা হয়েছে। ভারতের তরফে বলা হয়েছে, জন্ম-মৃত্যুর নথিভুক্তির যে পদ্ধতি রয়েছে এ দেশে, যাকে সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম বা সিআরএস বলা হয়, সেটি বিশাল এবং বহু দশক ধরে তার পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে। জন্ম-মৃত্যু নথিভুক্তি আইন ১৯৬৯-কে ভিত্তি করে এই কাজটি হয়ে থাকে। এবং দিনে দিনে বছর বছরে এই রেকর্ড করার পদ্ধতিতে উন্নতি হয়েছে।
কোভিড ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রধান ডা. এন কে অরোরা বলছেন, ২০১৮ সালে ৮৫ থেকে ৮৮ শতাংশ মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ। তিনি জানাচ্ছেন, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে সাত লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যু নথিভুক্ত করা হয়। এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে যেমন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, তেমনই গড় আয়ু বৃদ্ধির কথাটাও মাথায় রাখতে হবে।
আরও পড়ুন Explained: কোভিডের আঁচেই এবার এক পেট-খারাপের ব্যাক্টেরিয়ার ছোবল-সংবাদ
অর্থাৎ, বলা হচ্ছে, এই যে জন্মমৃত্যু রেকর্ডের সংখ্যা বেড়েছে, তা যতটা না জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি পরিকাঠামোর উন্নতির ফলে। এখানে স্বাস্থ্যকর্তাদের এমনও যুক্তি, হতে পারে, ১০-১৫ শতাংশ কোভিডে মৃত্যু নথিভুক্ত করা হয়নি, কিন্তু হলেও তো WHO-র দেওয়া হিসেবের কাছাকাছিও যাচ্ছে না সরকারি হিসেবপত্তর।
এখানে আরও একটু তলিয়ে ভাবা যেতে পারে এই তথ্য। ২০২০ সালে এদেশের মোট মৃত্যুসংখ্যা ৮১ লক্ষ ২০ হাজার, WHO-র হিসেব অনুযায়ী কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ওই বছর ৮ লক্ষ ৩০ হাজার জনের। কোভিড ছাড়া অন্যান্য কারণে তা হলে মৃত্যু মোটামুটি ৭৩ লক্ষ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ২০০৭ সালের পর থেকে কখনও ভারতের মোট মৃত্যুসংখ্যা ৮০ লক্ষের নীচে নামেইনি। তা হলে কী করে এটা সম্ভব? আসছে প্রশ্নবাণ।
২০২১ সালে WHO-র হিসেবে অনুযায়ী এ দেশে কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ৩৯ লক্ষ ১০ হাজারের। আর ভারতের সরকারি ফিগার ৩ লক্ষ ৩২ হাজার। এর মানে হল, ৯২ শতাংশ মৃত্যু গত বছর নথিভুক্তই করা হয়নি। যখন সরকার বাধ্যতামূলক ভাবে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে কোভিড মৃত্যুতে। মৃত্যু হলেই ক্ষতিপূরণের আবেদন করা হচ্ছে। তা হলে এমনটা কী ভাবে হতে পারে?
তবে এই ক্ষতিপূরণের আবেদন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ১১টি রাজ্যের ডেটা বলছে-- করোনায় মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণের যে দরখাস্ত করা হয়েছে ওই রাজ্যগুলি থেকে, মৃত্যু সেখানে তার দ্বিগুণ (এই ১১টা রাজ্যের মৃত্যুর সংখ্যা দেশের মোট মৃত্যুর ৭৫ শতাংশ)। এখানে যেমন দেখা যাচ্ছে, মহামারিতে মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের যে আবেদন গুজরাতের, রেকর্ড হওয়া মৃত্যুর সংখ্যা থেকে তা দশ গুণ বেশি। কেরলে আবার বিপরীত। আবেদনের চেয়ে বেশি নথিভুক্ত হওয়া করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা। ফলে মৃত্যু এবং ক্ষতিপূরণের আবেদন-- এই দুটির মধ্যেকার সম্পর্ক জটিল ধাঁধা হয়ে উঠেছে। এবং এখানে বলতে হবে, সুপ্রিম কোর্ট ফেক কমপেনসেশনের আবেদন সম্পর্কে সতর্কবার্তাও দিয়েছে। মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে ৬০ হাজার এ সংক্রান্ত আবেদন দেখা গিয়েছে ভুয়ো। ফলে কোভিডে মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণের আবেদনের মাধ্যমে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কোনও ভাবেই যুক্তিসঙ্গত হবে না।
হু বলছে, তারা হিসেব তৈরিতে সিআরএসের তথ্য যেমন নিয়েছে, তেমনই তথ্য জানার অধিকার আইনের মাধ্যমে জানানো আবেদনের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্যও বিচার-বিশ্লেষণ তারা করেছে। তারা ১৭টি রাজ্য এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকারি ডেটা ব্যবহার করেছে। কোনও একটি অঞ্চলে মৃত্যুর গতিপ্রকৃতি কী, তা বিচার করা হয়েছে। ফলে তাদের হিসেবে গোলযোগের সম্ভাবনা নাকি কম।
তা হলে এখন প্রশ্ন-- কারা ঠিক, কাদের হিসেব যথাযথ। কোনও একটাতে তো বিশাল ভুল রয়েইছে, না হলে এত বড় ফারাক হবে কেন দুইয়ের মধ্যে! কেন হবে?