পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইন কীরকম?

পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে এই আইন জারির পরবর্তী কালে পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করা সমস্ত নাগরিক জন্মসূত্রে পাক নাগরিক বলে গণ্য হবেন।

পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে এই আইন জারির পরবর্তী কালে পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করা সমস্ত নাগরিক জন্মসূত্রে পাক নাগরিক বলে গণ্য হবেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pakistan, Citizenship

অলংকরণ- অভিজিত বিশ্বাস

সদ্য পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ফলে ভারতের প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের এ দেশের নাগরিকত্ব প্রদানে বেশ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকত্বের আইনি অধিকারগুলি কী কী? পাকিস্তানের পরিস্থিতি একবার দেখে নেওয়া যাক।

Advertisment

ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার সাপেক্ষে পাকিস্তানের সাংবিধানিক প্রস্তাবনা কীরকম?

ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় দেশকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ এই দুটি বিষয় ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনীতে সংযুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে পৃথিবীর ৬০টি দেশে সংবিধান এক্ষেত্রে ঈশ্বরের উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জার্মানি, ব্রাজিল, গ্রিস এবং আয়ারল্যান্ডের মত দেশ। পাকিস্তানের সংবিধান শুরু হচ্ছে সর্বাপেক্ষা ক্ষমাপরায়ণ আল্লাহের নামে। সেখানে ব্রহ্মাণ্ডের সার্বভৌমত্ব ঈশ্বরকে দেওয়া হয়েছে এবং মুসলিম এবং ইসলামের উল্লেখ করা হয়েছে। লিয়াকত আলি খান ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ গণ পরিষদে এ প্রস্তাব আনার পর পরিষদের অমুসলিমরা এর বিরোধিতা করেন। শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, "রাষ্ট্রে ধর্মের কোনও সংস্থান নেই... রাষ্ট্র ধর্ম একটি বিপজ্জনক নীতি।"

পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হতে পারে, তবে এখানে নাগরিকত্বের জন্য কোনও ধর্ম পরীক্ষার ব্যাপার নেই। ১৯৫১ সালের পাকিস্তানে নাগরিকত্ব আইন ভারতের নাগরিকত্ব আইনের সমতুল্য এবং কোনও কোনও জায়গায় কিছুটা বেশি লিবারেলও বটে। এর ৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারির আগে পাকিস্তানে প্রবেশ করা সমস্ত ব্যক্তি দেশের নাগরিক বলে গণ্য। এ আইনের ৩ নং ধারায় (১৩ এপ্রিল, ১৯৫১) বলা হয়েছে কোনও ব্যক্তি, তাঁর বাবা-মা, বা তাঁদের বাবা-মাদের কেউ যদি ১৯৭৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনও অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তবে তিনি সেখানকার নাগরিক বলে গণ্য।

Advertisment

১৯৫১ সালের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত উপমহাদেশের যে কোনও জায়গা থেকে পাকিস্তানে স্থায়ী ভাবে বাস করার উদ্দেশ্যে সে দেশ প্রবেশ করা অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দিয়ে থাকে পাকিস্তান। ভারতীয় আইনের মতই পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইনের ৭ নং ধারায় বলা রয়েছে, ১৯৪৭ সালের ১ মার্চের পর ভারত থেকে যাঁরা পাকিস্তানে অভিবাসী হয়েছেন তাঁদের যদি পুনর্বাসন, বা স্থায়ী প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা না তাকে, তাহলে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।

পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে এই আইন জারির পরবর্তী কালে পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করা সমস্ত নাগরিক জন্মসূত্রে পাক নাগরিক বলে গণ্য হবেন। ভারত এ ক্ষেত্রে ১৯৮৬ সালে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বাবা-মায়ের যে কোনও একজনকে ভারতীয় নাগরিক হবার আবশ্যকীয়তা যুক্ত করে। ২০০৩ সালে সে মাপকাঠি কঠোরতর করা হয়।

২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইনে বাবা-মায়ের যে কোনও একজনকে ভারতীয় নাগরিক হবার কথা বলা হয়েছে, অন্যথায় বাবা-মায়ের যে কোনও একজনকে নাগরিক হতে হবে, এবং অন্যজনের অবৈধ অভিবাসী হওয়া চলবে না। পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইনের ৫ নং ধারায় উত্তরাধিকার সূত্রে নাগরিকত্ব দেবার ব্যাপারে, কোনও ব্যক্তির জন্মকালে বাবা বা মায়ের যে কোনও একজনকেই পাকিস্তানের নাগরিক হলে চলে।

Pakistan, Citizenship

পাকিস্তানে জম্মু-কাশ্মীরের অভিবাসীদের পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে গণ্য, যতদিন না পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্ক চূড়ান্ত হচ্ছে। ব্রিটিশ বাসিন্দারাও একইভাবে নাগরিক বলে গণ্য হবেন। এমনকি সরকার কমনওয়েলথ নাগরিকদের নাগরিকত্ব দিতে পারে।

পাকিস্তান এবং ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি কোথায় আলাদা?

ভারতের সংবিধানের মত পাকিস্তানের সংবিধানে এ ব্যাপারে আবডাল রাখা হয়নি। এখানে প্রস্তাবনাতেই বলে দেওয়া হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ঘোষণা, ধর্মীয় স্বাধীনতার অনুশীলন এবং সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থাদি রাখা হবে এবং সংখ্যালঘু ও অনুন্নত শ্রেণির বৈধ স্বার্থ রক্ষার্থে যথাবিহিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবশ্য সংখ্যালঘুদের বৈধ স্বার্থের বিষয়টিতে নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়েছে।

পাকিস্তানে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে কেবলমাত্র ওই দেশের নাগরিকদের। ভারতে বিদেশি সহ সকলকে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং সে কারণেই বিদেশি মিশনারিরা এ দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে পারেন।

পাকিস্তানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও, তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ইসলামের মহিমাকেও। এই নিয়ন্ত্রণের ফলে পাকিস্তানে পশ্চাদগতিশীল ধর্মনিন্দা আইন রয়েছে, যে আইনে মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য। ইসলামের ফৌজদারি আইনের নীতির বিরোধী হলেও এই দণ্ডপ্রথা সেখানে চালু। এর জেরে পাকিস্তানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতদূর সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠেই।

সংখ্যালঘুদের বৈধ স্বার্থ রক্ষার্থে পাকিস্তান কী ধরনের পদক্ষেপ করেছে?

৩৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সংখ্যালঘুদের বৈধ অধিকার ও স্বার্থে সুরক্ষা দেবে রাষ্ট্র। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরে তাদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়ও। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার হলেও সংবিধানে তাঁদের সংরক্ষণের কথা বলা রয়েছে। জাতীয় স্তরে তাঁদের জন্য ১০টি আসন সংরক্ষিত। বালোচিস্তানে, যেথানে জনসংখ্যার মাত্র ১.২৫ শতাংশ সংখ্যালঘু, সেখানে সংরক্ষণ রয়েছে ৪.৬২ শতাংশের জন্য। পাঞ্জাব প্রদেশে ২,৭৯ শতাংশ সংখ্যালঘু ও সংরক্ষণ ২.১৬ শতাংশের জন্য, সিন্ধে ৮.৬৯ শতাংশ সংখ্যালঘু ও সংরক্ষণের বন্দোবস্ত রয়েছে ৫.৩৬ শতাংশের জন্য। উত্তর পশ্চিম প্রদেশে ২.৪৬ শতাংশ সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ মাত্র ০.৫৬ শতাংশ।

দেশভাগোত্তর কালে ভারতে অভিবাসনের পর, বর্তমান পাকিস্তানে ১৯৫১ সালে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষের মত, যা মোট জনসংখ্যার ৩.৪৪ শতাংশ। ১৯৬১ সালের জনগণনায়, অমুসলিম জনসাধারণের সংখ্যা কমে ৭য় ২.৮২ শতাংশ। ১৯৭২ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়া. ৩.২৫ শতাংশে, ১৯৮১ সালে ৩.৩০ শতাংশে এবং ১৯৯৮ সালে ৩.৭০ শতাংশে।

পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত আইন

তেমন বিধি থাকলেও যদি তা রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তাহলে তা অসাংবিধানিক বলে গণ্য হবে। ভারতে ব্যক্তিগত আইন যদি সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তাহলে তা অবৈধ। সে কারণেই ২০১৭ সালে তিন তালাক আইন অবৈধ বলে গণ্য হয়েছে।

পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হিন্দুর বাস। ২০১৬ সালে সেখানে জোর করে ধর্মান্তরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন পাশ হয়। ২০১৮ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের বিধানসভায় শিখ আনন্দ বিবাহ আইন পাশ হয়েছে।

(ফৈজান মুস্তাফা সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ এবং হায়দারাবাদের নালসার আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য)

pakistan Citizenship Amendment Act