/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/02/shahid-aziz.jpg)
কার্গিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে পরে মুখ খুলেছিলেন শাহিদ আজিজ
আল কায়দা অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি জেনারেল শাহিদ আজিজের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেছে। আইএসআইয়ের বরিষ্ঠ পদাধিকারী থাকাকালীন শাহিদ আজিজ পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল মুশারফের কার্গিল অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। শোনা যায় তিনি সে সময়ে আইসিসের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়দা (AQIS) তাদের উর্দু ভাষার পত্রিকা নওয়া-এ-আফগানি জিহাদের ফেব্রুয়ারি সংস্করণে এ মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেছে বলে সৌদি আরবের সংবাদ গোষ্ঠী তাদের আরব নিউজের পাকিস্তানি সংস্করণে জানিয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়দা (AQIS) হল আল কায়দার আঞ্চলিক শাখা, যা ২০১৪ সালে আল কায়দা নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরি তৈরি আসিম উমরের নেতৃ্ত্বে, যে আসিম উমর হল আদতে উত্তর প্রদেশের সানাউল হক।
হক ওরফে উমর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আফগানিস্তানের হেলমন্দ প্রদেশে মার্কিন-আফগান যৌথ হামলায় মারা গিয়েছে বলে খবর।
আরব নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহিদ আজিজের মৃত্যুর খবর ২০১৮ সাল থেকে ঘুরে বেড়ালেও, এই প্রথম আল কায়দা এ খবরের সত্যতা স্বীকার করল।
আল কায়দার পত্রিকায় বলা হয়েছে, আজিজের সঙ্গে আল কায়দা সদস্যদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এবং তিনি তাঁর জীবন ও সঙ্গী সাথীদের নিয়ে একটা লেখা লিখেছেন যা ওই পত্রিকায় পরবর্তীকালে প্রকাশিত হবে। আরব নিউজের প্রতিবেদনে এসব কথা প্রকাশিত হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে বরিষ্ঠ সাংবাদিক সালিম মেহসুদকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, "এই প্রথম কোনও সংগঠন বলেছে আজিজের সঙ্গে কারও যোগাযোগ ছিল, এবং পত্রিকার পক্ষ থেকে যখন তাঁর লেখা প্রকাশ করবার কথা বলা হয়েছে, এ কথা তখন মনে করাই যায় যে তাতে চমকে দেবার মত কিছু তথ্য থাকবে।"
আজিজের পরিবারের তরফ থেকে এতদিন পর্যন্ত তাঁর জিহাদি ঝোঁকের কথা অস্বীকার করা হয়েছে, বলা হয়েছে, তিনি ধর্মীয় গোপন জীবন কাটান।
পাক সেনাবাহিনীতে আজিজের কেরিয়ার ও তার পর
আজিজ পাক সেনাবাহিনীর একেবারে ভিতরের লোক ছিলেন, সামরিক জীবন কাটিয়েছেন ৩৭ বছর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন তিনি, তার মধ্যে রয়েছে ডিরেক্টর জেনারেল মিলিটারি অপারেশনস, চিফ অফ জেনারেল স্টাফ এবং কম্যান্ডার অফ দ্য IV কর্পস।
সেনাবাগিনী থেকে আজিজ অবসর নেবার পর, জেনারলে পারভেজ মুশারফের সরকার তাঁকে সে দেশের সাংবিধানিক যুক্তরাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবেলিটি ব্যুরোর চেয়ারম্যান বানায়।
২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন তিনি। এর পরেই তিনি জিহাদে জীবন নিযুক্ত করার কথা স্থির করেন বলে মনে করা হয়।
কার্গিল অপারেশনে পাক সেনার ভূমিকা
মুশারফের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ছিলেন আজিজ। তিনি ছিলেন আইএসআইয়ের অ্যানালিসিস উইংয়ের ডিরেক্টর হিসেবে কার্গিলের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। পাকিস্তানি সাংবাদিক তথা লেখিকা নাসিম জেহরা তাঁর ২০১৮ সালের বই From Kargil To The Coup: Events That Shook Pakistan-এ কার্গিল অপারেশনে আজিজের ভূমিকার কিছুটা হদিশ দিয়েছেন।
পাকিস্তানি দৈনিক ডনে এ বই থেকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, "১৯৯৯ সালের ১৭ মে আইএসআইয়ের ওঝরি ক্যাম্প অফিসে প্রধানমন্ত্রী (নওয়াজ শরিফ)কে অপারেশন কো পাইমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়... যার প্রেক্ষিত ছিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি যে পাকিস্তানি সেনার ফায়ার কভারের আড়ালে মুজাহিদিনরা নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে।"
জেহরা লিখছেন, "ডিজিএমও তৌকির জিয়া যখন বিষয়টি বোঝাচ্ছিলেন, সে সময়ে সেখানে সেনা প্রধান পারভেজ মুশারফ, চিফ অফ জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজিজ খান, কম্যান্ডার ১০ কর্পস লেফটেন্যান্ট জেনারেল মহমুদ আহমেদ এবং ফোর্স কম্যান্ড নর্দার্ন এরিয়াস-এর কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাভেদ হোসেন সহ কার্গিল চক্রের সকলেই হাজির ছিলেন।"
"আইএসআইয়ের যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সেখানে হাজির ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আইএসআঅ ডিজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউদ্দিন ভাট, অ্যানালিসিস উইংয়ের ডিরেক্টর মেজর জেনারেল শাহি আজিজ এবং কাশ্মীর ও আফগানিস্তানের জন্য আইএসআইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জামশেদ গুলজার। এটাই ছিল কার্গিল অপারেশনের পরিকল্পনাকারী ও প্রয়োগকর্তাদের মধ্যে প্রথম বৈঠক।"
জেহরার মতে, "এই বৈঠকের মূল লক্ষ্য ছিল নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সেনাবাহিনীর সাফল্যের কথা নির্বাচিত নেতৃত্বকে অবগত করানো এবং অসামরিক অংশগ্রহণকারীদের অপারেশন বিষয়ে জানানো, কারণ জিহাদের বার্তা আরও বাড়বে, মুজাহিদিনরাই এই অপারেশন চালাচ্ছে এবং পাকিস্তান কেবলমাত্র তাদের সাহায্য করছে।"
আজিজের আপত্তি, কয়েক বছর পর
জেহরা লিখছেন, নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের কথা মাথায় রেথে কোনও সামরিক বাহিনীর কেউ সেদিন কোনও আপত্তি তোলেননি। তবে পরে স্পষ্ট হবে আইএসআইয়ের শীর্ষ কম্যান্ডারদের মধ্যে কেউ কেউ এর বিরোধী না হলেও, এ অপারেশন নিয়ে সংশয়ী ছিলেন।
সমালোচকদের অন্যতম শাহিদ আজিজ। জেহরা লিখছেন, "বেশ কয়েক বছর পর, আইএসআইয়ের অ্যানালিসিস উইংয়ের তৎকালীন শীর্ষপদাসীন মেজর জেনারেল শাহিদ আজিজ লিখছেন, অকার্যকর অনুমানের উপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিবেশের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে অতি সামান্য প্রস্তুতি সহ করা দুর্বল সামরিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এত গোপনীয়তার সেটা একটা কারণ হতে পারে। গোটা ব্যাপারটাই ছিল কেলেংকারি।"
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানি দৈনিক দ্য নেশনে আজিজ এই দৃষ্টিভঙ্গির কথা লেখেন। সে নিবন্ধে কড়া ভাষায় বিদ্রূপ সহযোগে মুশারফকে আক্রমণ করেন আজিজ।
আজিজ লিখেছিলেন, "কার্গিলে কোনও মুজাহিদিন ছিল না, শুধু রেকর্ড করা ওয়ারলেস মেসেজ ছিল, যা কাউকেই বোকা বানাতে পারেনি।"
তিনি বলেছেন, "পাকিস্তানি সেনাকে নিষ্ফলা শৈলশিরা দখল করতে বলা হয়েছিল হাতে ধরা অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে, মাথার ওপর কোনও কোনও সুরক্ষা ছাড়াই। তাঁদের বলা হয়েছিল, ভারত তেমন কোনও জবাব দেবে না, কিন্তু আজিজ লিখছেন, ভারত জবার দিয়েছিল পরপর, তাদের সাহায্য করছিল বিমানবাহিনীও।"
ভারতের হাতে পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে মুশারফ অস্বীকার করেন, মিডিয়ার মুখ বন্ধ করেন, এবং অবস্থান পাল্টে ফেলেন বলে লিখেছেন আজিজ।
আজিজ লেখেন, "আমরা ক্রমাগত নিষ্ঠুর উদ্যোগ নিয়ে চলেছি, আবডাল নিচ্ছি জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার। কফিনে আর কত পদক দেব আমরা? কত গান আর গাইব? আমাদের নীরবতা কত শহিদ আর ঢাকবে? যদি যুদ্ধের কোনও উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে আমরা সবাই মিলে যুদ্ধক্ষেত্রে যাব, কিন্তু যদি কোনও যুদ্ধে সত্য গোপন করতে হয়, তাহলে একথা ভাবতেই হয় যে আমরা কার স্বার্থ চরিতার্থ করছি?"
জিহাদে আজিজের বিশ্বাস
২০১৩ সালে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল একটি বই লেখেন, যার নাম "ইয়ে খামোশি কাহাঁ তক- এক সিপাহি কি দস্তান-এ-ইশক-ও-জুনুন"
সাংবাদিক, কৃতবিদ্য, সমাজকর্মী, ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত আমেরিকার পাকিস্তান রাষ্ট্রদূত যিনি নওয়াজ শরিফ ও বেনজির ভুট্টোর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন, সেই হুসেন হাক্কানির মতে এ বইয়ে আজিজের ইসলামি পাকিস্তানির প্রতি টান স্পষ্ট হয়।
হাক্কানি ২০১৮ সালের দ্য প্রিন্টে এক লেখায় বলেন, আজিজের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিক পৃথিবীর শয়তানি জীবনধারাকে একমাত্র রোধ করছে কোরাণ।
২০১৬ সালের পর থেকে আজিজকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। তাঁর পরিবারের কাউকে উদ্ধৃত করে কোনও কোনও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, তিনি সে বছরের গোড়ায় পাকিস্তান ছেড়ে সম্ভবত আফগানিস্তানে চলে গিয়েছেন এবং আইসিসের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে মুশারফ বলেন, তাঁকে "কিছু লোক" বলেছে যে আজিজ "মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, দাড়ি বাড়িয়েছেন এবং সিরিয়া চলে গিয়েছেন", যেখানে তিনি মারাও গিয়েছেন।
তবে আজিজের পুত্র জিশান আজিজ ভয়েস অফ আমেরিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁর বাবা "যেহেতু খুবই গোপন জীবন কাটান এবং তাঁর ভ্রমণ বা ধর্মকথা নিয়ে কোনও তথ্য দেননা, ফলে এসব শোনা কথা ছড়িয়েছে।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন