উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ারের কাপ্তেনবাবুর দলের নাম দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরা। কাপ্টেনবাবুর চরিত্রে অভিনয় করেন উৎপল। সে এক অলোকসামান্য অভিনয়। যাঁদের সৌভাগ্য হয়নি উৎপল দত্তকে স্টেজে দেখার, ক্যাসেটে টিনের তলোয়ার শুনেছেন তাঁদের অনেকে, এখন ইউটিউবের কল্যাণে তা সহজলভ্য। এখন অবশ্য সেই দিন গিয়েছে, টিভির পর্দায় তাকালেই দেখা যাচ্ছে নতুন বেঙ্গল অপেরা। নব-বাস্তবের ঢেলা-মাটিতে এক আশ্চর্য কদর্যতা। গা-ঘিনঘিনে। শিল্প কনকনে ঠান্ডায়, নাসার টেলিস্কোপেও কোনও উষ্ণতা দেখা যাচ্ছে না। বুঝতেই পারছেন, আমি বলতে চাইছি, নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়, এই অলীক কুনাট্য রঙ্গ।
বাঙালির কি এমন দিনই দেখবার ছিল। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা মুখোপাধ্যায়, টাকার পাহাড়-- এই সব। সত্যিকে সাত কোটি পেন্নাম করে গগন-চেরা চিৎকারে বলতে হচ্ছে— দাদা বাঙালি বাঁচতে চায়…। ভাগ্যদেবী হা-হা করে হাসতে হাসতে বলছেন, বাঙালি হয়েই আছো, মানুষ নয়। ছিলে কখনও, ইতিহাস থাক না পাথর-চাপা, আমাদের কপাল প্রশস্ত, আরও প্রশস্ত সে প্রস্তর, গোড়ায় দাঁড়িয়ে আগা দেখা যায় না। ফলে, আকাশে উড়িছে বকপাঁতি, বেদনা আমার তারি সাথি, গানটা গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়ো!… আসলে আমরা ভয় পেয়ে গেছি। ঘরে বসে গান করুন, কাঁদুন না যত খুশি, চেঁচান লাফান, বাইরে কিছু না বললেই হল, ক্যামেরা চলছে, শ্রীঘর হাঘরের মতো আপনার অপেক্ষায় হয়তো! কে জানে! আমরা সত্যিই বড় ভয় পেয়ে গেছি।
আমরা কি জানি, দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় আমরা আসলে দর্শক না, বা দর্শকও এখানে কুশীলব, স্টেজ আসলে অনেক অনেক বড় হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে দিকদিগন্তে। আমাদের হাতে রয়েছে টিনের তলোয়ার, যুদ্ধ করতে হবে টিনের তলোয়ার নিয়েই। কিন্তু আমরা তা চালাচ্ছি না তো। তলোয়ার ভেঙে টুকরো টুকরো হবে, টিনের তলোয়ার দিয়ে কি আর কালাশনিকভের সঙ্গে লড়া যায় নাকি! এও কি সম্ভব!
টিনের তলোয়ার নাটকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টুনকো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপাতেও কোনও দ্বিধা ছিল না, বীরত্ব এমনই, টিনের তলোয়ার এখানে প্রতীক, তা আসলে নাট্য-অস্ত্র, মেধার কামড়। নাটকের সংলাপগুলিই তো অস্ত্র। ইংরেজের গোলাবারুদের সামনে খেলনার বাধা, তা বলে কি লড়ব না, টিনের তলোয়ার তাই ওঠে। নাটকের সংলাপে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ, আগুন জ্বালে। তাতেই ব্রিটিশ কাঁপে, বসুন্ধরা শিহরিত হয়— ঠুনকো অস্ত্রই তখন অন্তরের অসীম শক্তির স্পর্ধা, পরমাণু যেমন বিশেষাবস্থায় শক্তির শিখর স্পর্শ করে, চেহারার ক্ষুদ্রতা তখন হেলাফেলার। সে মহাশক্তির সুনামি। মহাশক্তিধর আমাদের সেই মেধার দাপট, কোথায় গেল?
হ্যাঁ, অনেকেরই টিনের তলোয়ার চালানোর সাধ রয়েছে। ওই তলোয়ার নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়ার বাসনাও আছে। কিন্তু ছোটার অনেক আগে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে হয়, একেবারে বাড়ির উঠোনে। কিংবা দোরগোড়ার কুয়োয়। বুঝতে পারি না, হাজার লক্ষ কোটি বাঙালির হাতে যদি ওই টিনের তলোয়ারই ঝিকমিকিয়ে ওঠে, মেধা বিপুল গর্জন করে কালাশনিকভও তো কেঁদে ককিয়ে উঠবে। আসলে আমরা সব জানি, চাইলেই পারি, ভয়ে পেয়ে সব ভুলে গেছি, বড় ভয় পেয়ে গেছি!
রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা কিছু দিন ধরেই ভিতরে ঘুরছে, হয়তো অনেকেরই, ‘তোমার শঙ্খ ধূলায় পড়ে,/ কেমন করে সইব।/ বাতাস আলো গেল মরে/ একি রে দুর্দৈব।’ অতুলনীয় দুর্দিনে ধুলো থেকে শঙ্খ কে তুলবে, কোন জন, কোন দল? আমরা কোন্দলে! অপরের দিকে তাকিয়ে, আমরা other-ব্যাপারি, কই সেই স্বর, কই সেই স্বর করতে করতে হয়ে এল রাত ভোর। বিজ্ঞাপন দিয়েছি, নো অ্যাপ্লিকেশন। আমরা যে ভয়… পেয়ে… গেছি…
শঙ্খ ঘোষের অভাব, বড় বাজছে। ‘সবাই আমায় কর তোয়াজ-/ ছড়িয়ে যাবে দিগ্বিদিকে/ মুক্ত গণতন্ত্র আজ।’ লিখেছিলেন, অনুব্রতকে মারাত্মক বিব্রত করে দিয়েছিলেন। পিনাকেতে টঙ্কার- জার্কের অনুভব দিয়েছিলেন সাম্প্রতিকে। সব সৃজনশক্তি নিশ্চয়ই কর্তাভজা বা বাদামভাজা নয় এখনও, নয় ভাইরাল ভিডিও সবাই, কিন্তু সেই টঙ্কারটা কই গো, যা বাঙালির জিনে রয়েছে, যে জেগে উঠে হয়ে ওঠে বিদ্রোহী জিনি, তাকেই আমরা চিনি, যাকে দেখছি সেই বাঙালিকে চিনি না, এই আত্ম আমাদের অজানা। মাছি যার মেধার রসে বসে আছে, ফুস ফুস করে খেয়ে সাবাড় করছে। ‘যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’ অদ্ভুত আঁধার এক-- জীবনানন্দের কথাগুলি মনে করুন, খাপে খাপ হয়ে যাবে। ‘যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়/ মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’