জ্বালানির মুল্যের ঝাঁজে গলদঘর্ম অবস্থা মধ্যবিত্তের। গোটা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও পেট্রল অনেক আগেই সেঞ্চুরি পার করেছে। বৃহস্পতিবার শহরে পেট্রলের দাম ১০৮ টাকা ৭৮ পয়সা। একইভাবে রাজ্যের একাধিক জেলায় সেঞ্চুরি পেরিয়েছে ডিজেল। এদিন শহরের পাম্পগুলোতে ডিজেলের দাম ছিল ১০০ টাকার কিছু বেশি। এই অবস্থায় গলদঘর্ম অবস্থা পরিবহণ ব্যবসায়ীদের। ক্রমেই দাম বাড়ছে সবজি এবং ফলের। সম্প্রতি দিল্লিতে জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে পেট্রল-ডিজেলের মূল্য নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। যদিও একটা আভাস ছিল, হয়তো জিএসটি আওতাভুক্ত হবে এই দুই পরিবহণ জ্বালানি। কিন্তু সবপক্ষ সহমত না হওয়ায় ঝুলে সিদ্ধান্ত।
দামবৃদ্ধি নিয়ে চলছে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, দায় চাপানোর পালা। রাজ্য বলেছে কেন্দ্র দায়ী। কেন্দ্র পাল্টা বলছে জ্বালানির উপর বসানো ট্যাক্স থেকে ভরা হচ্ছে রাজ্যের কোষাগারও। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক বলছে, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ায় আগুন পেট্রল-ডিজেল। রাহুল গান্ধি বলছেন, ‘কর তোলাবাজি করছে মোদি সরকার। কেন্দ্রের নিজের ভাগের ট্যাক্স ছাড়ুক। তাহলেই অনেকটা কমবে দাম।‘
এই দুয়ের মাঝে পড়ে হাঁসফাঁস করছে আম জনতা। অস্বাভাবিক এই দামবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে শহরে বসে গিয়েছে একাধিক বেসরকারি বাস। রুট ছোট করেছে অনেক বাস। ওলা বা উবের প্রিমিয়ার সার্ভিস বুকিংয়ে চলছে না এসি।
একটু আরামের জন্য বেশি পয়সা দিয়ে অ্যাপ ক্যাবে চেপেও এসি না মেলায় অনেক সময় সংঘাত বাঁধছে যাত্রী-চালকের। এই প্রসঙ্গে ডানলপ থেকে সেক্টর-৫ পর্যন্ত সপ্তাহে তিন দিন যাত্রা করা এক তরুণীর মন্তব্য, ‘যে তিন দিন অফিস যাই, ডানলপ থেকে উবের বা ওলা প্রিমিয়ার সার্ভিস বুক করেই যাই। কিন্তু এসি চালাতে বললেই আচরণ বদলে যায় চালকদের। এসি না চালানোর নানা অজুহাত দেখাতে শুরু করেন। আমরা বুঝতে পারি জ্বালানির মূল্য কী হারে বেড়েছে। সেই ভাবে বেড়েছে ওলা বা উবেরের প্রিমিয়ার সার্ভিসের রেন্ট। তাতেও টাকা দিয়ে আরামদায়ক সফর পাই না।‘
এয়ারপোর্ট এক নম্বর এলাকার এক পেট্রল পাম্পে গিয়ে দেখা গিয়েছে অন্য ছবি। এখানে যারা আসছেন প্রত্যেকেই ফুল ট্যাংকি করছেন দুই চাকা বা চার চাকা। এই কাজের পিছনে যুক্তি হিসেবে বলছেন, ‘যেহেতু প্রতিদিন দাম বাড়ছে, তাই যতটা সম্ভব ট্যাংক ফুল রেখে পকেটকে একটু সাশ্রয় দেওয়া।‘ একইভাবে উষ্মা প্রকাশ করেছে বাস মালিক সংগঠন। তারা বলেছে, টিকিট থেকে যা আয়, তার বেশিরভাগ চলে যাচ্ছে তেল ভরতে। বিরোধীরা বলছে, প্রথম মোদি সরকারের শুরুতে ১১৫ ডলার ছিল প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল। সেই সময় পেট্রোল ছিল ৭০-৭৫ টাকা প্রতি লিটার আর ডিজেল ছিল ৬০-৬৫ টাকা প্রতি লিটার।
করোনাকালে একটা সময় চাহিদা তলানিতে থাকায় ৪৫ ডলার প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পাওয়া গিয়েছে। সেই সময় থেকেই এদেশে দাম চড়েছে এই দুই জ্বালানির। যে চড়া দাম এখন বাড়তে বাড়তে সেঞ্চুরি ছাড়িয়েও দৌড়চ্ছে। কিন্তু ঘটনাচক্রে এখন প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ৮৫ ডলার। তা সত্বেও কেনও জ্বালানির দামের জ্বালায় হাঁসফাঁস অবস্থা আম জনতার? এমন প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি বিরোধী দলগুলো। সম্প্রতি রাহুল গান্ধি এই মহার্ঘ জ্বালানিকে ‘ট্যাক্স তোলাবাজি’ কটাক্ষ করেছে। কেন্দ্র, তার ভাগের কর কমালে ৮০ টাকার নীচে নেমে আসবে প্রতি লিটার পেট্রোল এবং ৭০ টাকার নীচে নামবে প্রতি লিটার ডিজেল। এমনটাই মন্তব্য তাঁর।
এবার এই প্রতিবেদন লেখার ফাঁকে দীপাবলি উপহার ঘোষণা করে দিয়েছে কেন্দ্র। পেট্রলে আন্তঃশুক্ল ৫ টাকা আর ডিজেলে আন্তঃশুল্ক ১০ টাকা কমিয়েছে কেন্দ্র। ফলে দীপাবলির আগে অনেকটা সুরাহা মধ্যবিত্তের। এই নতুন দাম ৪ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। যদিও একে নির্বাচনী ভাঁওতা বলে কটাক্ষ করেছে বিরোধী শিবির। ১০ টাকা বাড়িয়ে ৫ টাকা কমানো হয়েছে এভাবেই সরব তারা। এই কর ছাড়েও ১০০ টাকার নীচে নামবে না প্রতি লিটার পেট্রল এবং ৮০ টাকার নীচে যাবে না প্রতি লিটার ডিজেল। বিরোধীদের সুরে সুর মিলিয়ে এমনটাই দাবি বিশেষজ্ঞদের।
আরও পড়ুন জ্বালানির আগুন দামের ছ্যাঁকা সবজি বাজারে, নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্তের
এবার ঠিক কী কী ভাবে ট্যাক্স চেপে এখন আকাশ ছোঁয়া পেট্রোল-ডিজেল। তেলের মূল দাম (বেস প্রাইস+কেন্দ্রের শুল্ক+ পরিবহণ খরচ+ রাজ্যের ভ্যাট+ ডিলার্স কমিশন)= পেট্রোল পাম্পে জ্বালানির দাম। এই রাজ্যে ভ্যাটের হার পেট্রলে লিটার পিছু ২৫% আর ডিজেলে ১৭%। কেন্দ্রীয় শুল্ক পেট্রল এবং ডিজেলে যথাক্রমে ১০ টাকা এবং ৫ টাকা কমেছে। ফলে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলোর পাম্পে রাজ্যের জন্য: পেট্রল ৫ টাকা ৮২ পয়সা কমে ১০৪ টাকা ৬৭ পয়সা/লিটার এবং ডিজেল ১১ টাকা ৭৭ পয়সা কমে ৮৯.৭৯ পয়সা/লিটার। একই আছে রাজ্যের ভ্যাট।
সেই হিসেব নীচে উল্লিখিত (দিল্লির দর অনুযায়ী)—
এখন বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত তেলের দাম ৮৫.৮৯ ডলার। এক ডলার সমান ভারতীয় মুদ্রা ৭৪ টাকা ৭৮ পয়সা। তাহলে এক ব্যারেল অপরিশোধিত তেল কিনতে লাগে ৬৪২২ টাকা। প্রতি ব্যারেলে অপরিশোধিত তেল থাকে ১৫৯ লিটার। প্রতি লিটার অপরিশোধিত তেলের দাম ৪০ টাকা ৩৯ পয়সা।
অপরিশোধিত তেল থেকে পেট্রল-ডিজেল উৎপাদন খরচ—এক লিটার পেট্রোল ৪০ টাকা ৩৯ পয়সা, এক লিটার ডিজেল ৪০ টাকা ৩৯ পয়সা। পরিশোধন, পরিবহণ এবং অন্য খরচা প্রতি লিটার পেট্রলে ৪ টাকা ৫৯ পয়সা এবং প্রতি লিটার ডিজেলে ৬ টাকা ৩ পয়সা।
পেট্রল এবং ডিজেল সম্পূর্ণ নির্গমণের খরচ (অর্থাৎ পেট্রল পাম্পে প্রাপ্য জ্বালানি)—৪৪ টাকা ৯৮ পয়সা প্রতি লিটার পেট্রল আর ৪৬ টাকা ৬৯ পয়সা প্রতি লিটার ডিজেল।
কেন্দ্রীয় কর এবং ডিলারদের কমিশন (পেট্রল/লিটার)--- অতিরিক্ত আন্তঃশুক্ল + কেন্দ্রের পরিবহণ কর (৩২.৯ টাকা)+ ডিলার কমিশন (৩.৮ টাকা) =৩৬.১৭ টাকা।
একইভাবে কেন্দ্রীয় কর এবং ডিলারদের কমিশন (ডিজেল/লিটার)--অতিরিক্ত আন্তঃশুক্ল + কেন্দ্রের পরিবহণ কর (৩১.৮ টাকা)+ ডিলার কমিশন (২.৬ টাকা)= ৩৪ টাকা ১৪ পয়সা
এবার ভ্যাট বসার আগে
পেট্রল প্রতি লিটার—৪৪.৯৮ টাকা + ৩৬.১৭ টাকা= ৮১ টাকা ১৫ পয়সা
ডিজেল প্রতি লিটার-- ৪৬ .৬৯ টাকা+ ৩৪.১৪ টাকা= ৮০ টাকা ৮৩ পয়সা
এবার ভ্যাট বসে ৩০% পেট্রলের উপর আর ১৬.৭৫% ডিজেলের উপর—সেই হিসাবে প্রতি লিটার পেট্রলে ভ্যাট যুক্ত হয় ২৪.৫ টাকা আর ডিজেলে ভ্যাট যুক্ত হয় ১৩.৮৩ টাকা।
এই হিসেবে অক্টোবর পর্যন্ত দিল্লিতে পেট্রল ১০৫ টাকা ৬৫ পয়সা আর ডিজেল ৯৪ টাকা ৬৬ পয়সা। ভ্যাট যেহেতু রাজ্যভিত্তিতে ওঠানামা করে তাই অক্টোবর পর্যন্ত বাকি মেট্রো শহরে প্রতি লিটার পেট্রল এবং ডিজেলের দামে হেরফের ছিল। উপরে পেট্রল-ডিজেলে বসা করচিত্র স্পষ্ট করা হয়েছে। ভ্যাটের হিসেব দেখানো হয়েছে শুধুমাত্র দিল্লিতে।
এই প্রসঙ্গে বিরোধীদের দাবি, নভেম্বর ২০১৪-তে পেট্রলে কেন্দ্রের আন্তঃশুল্ক ছিল ৯ টাকা ২০ পয়সা। সেটা ২০২১-এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ টাকা ৯০ পয়সা। এর সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে পথকর। একইভাবে ৭ বছর আগে ডিজেলে কেন্দ্রের আন্তঃশুল্ক ছিল ৩ টাকা ৪৬ পয়সা আর ২০২১-এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ টাকা ৮০ পয়সা। এর সঙ্গেই যুক্ত পথকর। একইভাবে রাজ্যভিত্তিক ভ্যাটের নিরিখে ২০১৪ সালে পেট্রলের বেসিক দরে কর বসত ২০% আর ২০২১ সালে বসে ৩০%। ডিজেলের বেসিক দরে ৭ বছর আগে ভ্যাট বসত ১২.৫% আর এখন বসে ১৬.৭৫%। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিশেষ সেস। আর এই যে বিপুল করভার-সহ জ্বালানির দর জনতাকে বহন করতে হয়, তার ৬৩% লাভের গুড় ঘরে তোলে কেন্দ্র আর বাকি ৩৭% যায় রাজ্যের কোষাগারে। এমনটাই জানান বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ কম ট্যাক্স বসিয়ে কম লাভবান রাজ্য আর বিপুল ট্যাক্স বসিয়ে অনেক লাভবান রাজ্য। এমনটাই বিজেপি-বিরোধী দলগুলোর দাবি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন