২৬ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের প্রতিটি পঞ্চায়েতে যৌথভাবে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করা হবে, জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আগে। তার পর থেকে এই ব্যবস্থা চলতে থাকবে। উদ্ধব ঠাকরে সরকার এই নির্দেশ দিয়েছে।
সারা দেশ জুড়ে ক্যা ও এনআরসি নিয়ে যে বিক্ষোভ চালু হয়েছে, তার আঁচ পড়েছে মহারাষ্ট্রেও। সে পরিপ্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত।
প্রস্তাবনা কী, ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার ইতিহাস কীরকম?
প্রস্তাবনা হল কোনও নথির প্রারম্ভিক বিবৃতি যাতে ওই নথির দর্শন ও উদ্দেশ্য বর্ণিত থাকে। সংবিধানের ক্ষেত্রে, এতে সংবিধান রচয়িতাদের উদ্দেশ্য, তৈরির ইতিহাস এবং দেশের আদত মূল্যবোধ ও নীতি লিপিবদ্ধ রাখা হয়।
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার আদর্শ জওহরলাল নেহরু বর্ণিত, যা ২২ জানুয়ারি ১৯৪৭-এ গণ পরিষদ গ্রহণ করেছিল।
আদালতে বলবৎ না হলেও, সংবিধানের প্রস্তাবনায় সংবিধানের উদ্দেশ্য বর্ণিত রয়েছে, যা কোনও অনুচ্ছেদের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে অসুবিধা হলে কাজে লাগে।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা রয়েছে,
"আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে চাই। একই সঙ্গে এর নাগরিকদের
সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার
চিন্তা, প্রকাশ, বিশ্বাস, আস্থা ও উপাসনার স্বাধীনতা
মর্যাদা ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে চাই
এবং তাদের সকলের মধ্যে সকল ব্যক্তির মর্যাদা ও দেশের ঐক্য ও সংহতি নিশ্চয়তাদায়ী সৌভ্রাতৃত্ব বাড়িয়ে তুলতে চাই"
"আমাদের বিধান পরিষদ, ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এই সংবিধান গ্রহণ করল, কার্যকর করল ও আমাদের হাতে সংবিধান তুলে দিল।"
প্রস্তাবনার মূল শব্দগুলির অর্থ কী?
"আমরা, ভারতের জনগণ" বলতে ভারতের মানুষের চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব বোঝায়।
এখানে ভারতকে "প্রজাতন্ত্র" হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা থেকে বোঝায় সরকার হবে জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য।
এখানে উদ্দেশ্য হিসেবে "সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়ের" কথা বলা হয়েছে।
১৯৫৬ সালে নেহরু বলেছিলেন, "গণতন্ত্রের কথা মুখ্যত আগে যা বলা হয়েছে, রাজনৈতিক গণতন্ত্রে মুখ্যত সব মানুষের ভোটাধিকার রয়েছে। কিন্তু যে মানুষ একেবারে নিচে রয়েছে, বাইরে রয়েছে, ধরুন যে মানুষটা উপোসী, ক্ষুধার্ত, তার একটা ভোট তার প্রতিনিধিত্ব করে না। রাজনৈতিক গণতন্ত্র যথেষ্ট নয়, যদি না এর মাধ্যমে কেবল অর্থনৈতিক গণতন্ত্র, সমতার ক্রমবর্ধমানতার পরিমাপ করা যেতে পারে, এবং যদি না জীবনের সুন্দর জিনিসগুলি অন্যদের কাছে ছড়িয়ে না দেওয়া যেতে পারে এবং মোটাদাগের অসাম্যগুলি দূর করা যেতে পারে।"
"স্বাধীনতা", "সমতা" ও "সৌভ্রাতৃত্ব"কেও আদর্শ ধরা হয়েছে।
বি আর আম্বেদকর বিধান পরিষদে তাঁর অন্তিম ভাষণে বলেছিলেন, "রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে সামাজিক গণতন্ত্র না থাকলে তা টিকে থাকতে পারে না। গণতন্ত্র মানে কী? তার মানে এমন একটা জীবন যেখানে স্বাধীনতা, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় যে তিনটি পৃথক নয়। এই তিনে মিলে একটি সংযুক্তি তৈরি হয় যার একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেই গণতন্ত্র তার উদ্দেশ্য হারাবে। স্বাধীনতাকে সমতার থেকে আলাদা করা যায় না, সমতাকে পৃথক করা যায় না স্বাধীনতার থেকে। আবার সৌভ্রাতৃত্বের থেকে স্বাধীনতা ও সমতাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।"
১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনীতে 'সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে'র জায়গায় 'সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' গৃহীত হয়েছে। সে সময়ে 'দেশের ঐক্য'-কে বদলে 'দেশের ঐক্য ও সংহতি' করা হয়েছে।
অন্যান্য দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় কী আছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (গৃহীত ১৭৮৭)
আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, আরও ভালো ইউনিয়ন তৈরি করতে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে, দেশীয় শান্তি নিশ্চিত করতে, সাধারণ সুরক্ষা দিতে, সাধারণ কল্যাণ বর্ধিত করতে এবং স্বাধীনতার আশীর্বাদ আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুরক্ষিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রতিষ্ঠা করছি।
ফ্রান্স (১৯৫৮)
ফরাসি জনসাধারণ ১৭৮৯ ঘোষণা দ্বারা সংজ্ঞায়িত জাতীয় সার্বভৌমত্বের নীতি ও মানুষের অধিকার, ১৯৪৬ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় যা সুনিশ্চিত করা হয়েছে এবং ২০০৪ সালের পরিবেশ সনদে যে অধিকার ও কর্তব্য সংজ্ঞায়িত হয়েছে, তার সঙ্গে নিজেদের সংযোগ ঘোষণা করছে।
এই নীতিসমূহের দ্বারা এবং জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের বলে বলীয়ান হয়ে এই প্রজাতন্ত্র ভিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল যারা স্বাধীনতা, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্বের সাধারণ আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত নয়া প্রতিষ্ঠানকে মেনে চলার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে এবং গণতান্ত্রিক উন্নয়নের লক্ষ্য ধারণ করে চলেছে, তাদের দিকে হাত বাড়াতে চায়।
অনুচ্ছেদ ১
ফ্রান্স অবিভক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সামাজিক গণতন্ত্র হবে। আইন যাতে উৎপত্তি, জাতি ও ধর্মগত বিভাজন না করে সকলকে সমান চোখে দেখে তা নিশ্চিত করা হবে। সমস্ত বিশ্বাসকে মর্যাদা দেওয়া হবে। বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে একে গঠন করা হবে।
সমস্ত নির্বাচনী দফতর ও পদে, সমস্ত পেশাদার ও সামাজিক দায়িত্বে নারী ও পুরুষ যাতে সমানাধিকার পান তা দেখা হবে।
রাষ্ট্রসংঘের সনদ (১৯৪৫)
আমরা রাষ্ট্রসংঘের জনগণ স্থিরপ্রতিজ্ঞ
— আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করবতে যা দুদুবার আমাদের জীবৎকালে মানবজাতির পক্ষে অবর্ণনীয় দুঃখের কারণ হয়েছে, এবং
— মৌলিক মানবাধিকারে, মানুষের মূল্য মর্যাদায়, নারী পুরুষের সমানাধিকারে এবং সমস্ত ছোট বড় দেশের প্রতি আমাদের বিশ্বাস পুনরুচ্চারণ করতে, এবং
— তেমন পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠা করতে যার আওতায় ন্যায়বিচার ও সমস্ত চুক্তির দায়বদ্ধতার প্রতি সম্মান ও আন্তর্জাতিক আইন যাতে রক্ষা করা হয়, এবং
— সামাজিক প্রগতি, উচ্চতর জীবনচর্যা ও বৃহত্তর স্বাধীনতাকে বর্ধিত করতে,
এবং আমাদের অন্তিম লক্ষ্য
— সহিষ্ণুতা পালন করা এবং সুপ্রতিবেশী হিসেবে একে অন্যের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করা, এবং
— আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় আমাদের আমাদের শক্তি একত্রিত করা এবং
— নীতি ও পদ্ধতি মেনে যাতে সশস্ত্র শক্তি ব্যবহৃত না হয়, তা সুনিশ্চিত করা, সাধারণ স্বার্থের জন্য রক্ষা করা এবং
— সমস্ত মানুষের আর্থিক ও সামাজিক প্রগতির জন্য আন্তর্জাতিক পরিকাঠামো কাজে লাগানো
আমাদের যৌথ প্রচেষ্টার লক্ষ্য হিসেবে আমরা এগুলি নির্ধারণ করেছি
আমাদের সংশ্লিষ্ট সরকারগুলি, তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সানফ্রান্সিসকো শহরে মিলিত হয়েছেন, যাঁরা সম্পূর্ণ ক্ষমতা যথাযোগ্যতায়, ভালোভাবে প্রদর্শন করেছেন, তাঁরা সকলে মিলে রাষ্ট্র সংঘের বর্তমান সনদে সম্মত হয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছেন।