পেগাসাস। গ্রিক পুরাণের ঘোড়া। পক্ষীরাজ। সাদা ধবধবে। গ্রিক দেবতাদের ‘ডন’পসাইডনের সন্তান এই ডানাওয়ালা অশ্ব। এর সঙ্গে জড়িয়ে কবিতা। ঈশ্বরী অ্যাথিনার কাহিনি। কিন্তু পেগাসাস এখন ত্রাস। শ্বাস রুদ্ধ হওয়ার দশা এতে। মাথা ঘুরন্ত তাবড় রাজনীতিবিদের, পেগাসাস তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে হ্যাকিংয়ের আতঙ্ক ডেকে এনেছে। এই পক্ষীরাজ ঘোড়া যে কখন উড়ে গিয়ে কার স্মার্টফোনে সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে সব তথ্য নিয়ে বেরিয়ে আসবে কেউ জানে না। একের পর এক তেমন তথ্য সামনে আসতেই হইচই।
বলা হচ্ছে, ইজরায়েলি এই স্পাইওয়্যার নাকি ব্যবহার করা হয়েছে অন্তত একশো জন ভারতীয়ের বিরুদ্ধে। বিরোধীরা কাঠগড়ায় তুলেছে মোদী সরকারকে। সংসদে বিরোধী-গর্জন শোনা যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে, চার বছর আগে জাতীয় নিরাপত্তা সচিবালয়ের বাজেট বাড়ানো হয়েছিল দশ গুণ। যার বেশির ভাগটাই সাইবার সিকিয়োরিটি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে খরচ করা হয়। বিরোধীদের একাংশের প্রশ্ন, পেগাসাস কেনার জন্যই কি এই খরচ? নজরদারি, যে কোনও সরকারের হাতিয়ার। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কে কী বলছে, তা না জানতে পারলে, রাষ্ট্রের পতন এড়ানো ভীষণ মুশকিল।
ভারতে নজরদারি চালানোর জন্য দুটি আইন রয়েছে। টেলিগ্রাফ আইন ১৮৮৫। এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইন ২০০০। টেলিগ্রাফ আইনের মাধ্যমে ফোন-কলে মাথা গলানোর, আড়িপাতার চমৎকার অধিকার রয়েছে। এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সব রকমের বৈদ্যুতিন নজরদারির ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রের। টেলিগ্রাফ আইনের ৫-এর ২ নম্বর ধারায় কী বলছে? ‘কোনও ধরনের পাবলিক এমার্জেন্সি, কিংবা জনসুরক্ষার প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার, কিংবা কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের অনুমোদনে কোনও সংস্থা দেশের সার্বভৌমত্ব, একতা, নিরাপত্তা, কিংবা অন্য কোনও দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্কের স্বার্থে, কোনও ধরনের অপরাধমূলক উস্কানি রুখতে…’ কোনও ফোন-বার্তায় নজরজারি চালাতে পারবে। মত প্রকাশের অধিকারে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি দেওয়া হয়েছে। ভারতের একতা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে কিংবা কোনও অপরাধের জন্য উসকানিমূলক বক্তব্যের ক্ষেত্রে সরকার দেশদ্রোহ আইন বলে পদক্ষেপ করতে পারে।
অন্য দিকে, তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৬৯ ধারা এবং ২০০৯-এর তথ্য-প্রযুক্তি নিয়মে বৈদ্যুতিন নজরদারিতে সিলমোহর দিয়েছে। এর ফলে পেগাসাসের মতো স্পাইওয়্যারও ব্যবহার করা যায় আইনের অস্ত্রে।
সুপ্রিম কোর্টে ১৯৯৬ সালে পাবলিক সিভিল লিবার্টিস বনাম কেন্দ্রীয় সরকারের মামলায় শোরগোল পড়েছিল। সিবিআইয়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ফোন ট্যাপিং নিয়ে এই মামলা। সুপ্রিম কোর্ট টেলিগ্রাফ আইনের কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা তুলে ধরে। এ নিয়ে গাইডলাইনও নির্দিষ্ট করে। আদালত বলে, ফোন-কলে আড়িপাতার ক্ষেত্রে কোনও রেকর্ড রাখা হচ্ছে না।…'ট্যাপিং ব্যক্তিগোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ। ফোনে কথাবার্তা চালানোর যে অধিকার কেউ কিনেছে, তাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নাক গলানো। এটা ঠিক, এমনকী গণতান্ত্রিক সরকারকেও গোয়েন্দাগিরির প্রয়োজনে গোপনে এমন পদক্ষেপ করতে হয়, কিন্তু তা যেন কোনও সংস্থার অপরাধে পর্যবসিত না হয়, সে দিকে নজর রাখতে হবে-- তা থেকে আম জনতাকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।'
আরও পড়ুন কীভাবে চাঁদের অস্থিরতা সাগরের ঢেউয়ের উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে?
সুপ্রিম কোর্টের এই গাইডলাইন ২০০৭ সালে টেলিগ্রাফ আইনে রুল ৪১৯ (এ) হিসেবে ঢোকানো হয়। ২০০৯ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনেও এই গাইডলাইন্স রাখা হয়।
রুল ৪১৯ (এ) কী বলছে?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কোনও সচিব, রাজ্যের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র দফতরের কোনও সচিব পর্যায়ের আধিকারিক আড়িপাতা নিয়ে নির্দেশ দিতে পারেন। তবে, এড়ানো সম্ভব নয় এমন পরিস্থিতিতে এটা করতে হবে। কেন্দ্রের যুগ্ম সচিব স্তরের নীচে কোনও অফিসার এই নির্দেশ দিতে পারবেন না। এবং এতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব কিংবা (রাজ্যের ক্ষেত্রে) রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের অনুমোদন থাকতে হবে।
কোথায় ফাঁক
আইনের ফলে ব্যক্তি-গোপনীয়তা কি খর্ব হচ্ছে? ২০১২ সালে পরিকল্পনা কমিশন এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে এক দল বিশেষজ্ঞকে বিষয়টি নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আইনের ফাঁকটা কোথায়, তা-ই বার করা ছিল এঁদের লক্ষ্য। বিশেষজ্ঞ দলের মাথায় ছিলেন দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এ পি শাহ। সেন্টার ফর ইন্টারনেট অ্যান্ড সোসাইটির একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই কমিটি আইনের বিচ্যুতির বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছিল। বিচার করেছিল অনুপুঙ্খ ভাবে।
কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। আইনের অপব্যবহারটাই যে এখন দস্তুর। হাজার গাইডলাইন্স, হাজার নিয়মের নিগড় এখানে ভ্যানিস হয়ে যায়, কে শোনে কার কথা, এটাই রিংটোন। আইনের ধুয়ো তুলে আইনভঙ্গে কবে লাগাম পরানো যাবে? গ্রিক পুরাণের সাদা পক্ষীরাজ ঘোড়া থুড়ি পেগাসাসকে রাষ্ট্র নামে এই অট্টালিকার দরজায় বেঁধে রাখতে কি আকাশে কেউ ঝাঁপ দেবে না কোনও দিন?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন