বাংলায় যে দুর্গাপূজা হয়, তার সঙ্গে রামায়ণের যোগ আছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণে বা উত্তর ভারতের কোনও রামায়ণে সেই উল্লেখ নেই। তুলসীদাসও অকাল বোধনের কথা বলেননি। তবে কৃত্তিবাস ওঝার বাংলা রামায়ণে সেকথা পাওয়া যায়। বাল্মীকির রামায়ণে ও কৃত্তিবাসের রামায়ণে বহু পার্থক্য আছে। যেমন স্বয়ং বাল্মীকি নিজের পিতার নাম বলছেন প্রচেতা। কৃত্তিবাস ওঝা বলছেন, তিনি চ্যবনের পুত্র। প্রচেতা ও চ্যবন অভিন্ন ব্যক্তি নন। বিশাল মহাকাব্যের এমন পাঠান্তর দেশকালভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে কৃত্তিবাসের রামায়ণের পাশাপাশি দুটি পুরাণ এবং স্মৃতিশাস্ত্র থেকে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার সপক্ষে বলিষ্ঠ প্রমাণ দেওয়া যায়। সাধারণত মনে করা হয়, শরৎকালে দেবদেবীরা নিদ্রিত থাকেন। রাবণ-বধের জন্য নরচন্দ্রমা রাম দেবী দুর্গার অকালে বোধন করেন। ফল, রাবণের পরাজয় ও সীতা উদ্ধার।
দুর্গাপূজা আদি সন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, জগতে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আছে, পরমাত্মা কৃষ্ণ সৃষ্টির প্রথম কালে মহারাসমণ্ডলে এই আরাধনা করেন। তার পর ব্রহ্মা। মধু ও কৈটভ নামক দুই অসুরের হাত থেকে ত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে। তৃতীয় পূজা করেন শিব, ত্রিপুর নামে এক অসুরের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। ত্রিপুর আসলে তিন রকমের - তারকাক্ষ, কমলাক্ষ ও বিদ্যুন্মালী। চতুর্থবার আরাধনা করেন দেবরাজ ইন্দ্র। লক্ষ্মীকে ফিরে পাওয়ার জন্য।
মহাভারতে দুর্গাপূজার কথা বিস্তৃতভাবে রয়েছে। কপট পাশা খেলায় শকুনির কাছে দ্বিতীয়বার পরাজিত হয়ে পাণ্ডবদের বারো বছর বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস হয়। অজ্ঞাতবাসের সময়টি ছিল বেশ কঠিন। কারণ, এই সময় পাণ্ডবরা দুর্যোধনাদি কৌরবদের কাছে ধরা পড়ে গেলে তাঁদের আবারও লুকিয়ে লুকিয়ে কাটাতে হবে। এমন করে তো অনন্তকাল চলতে পারে না। এই চক্র থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যুধিষ্ঠির দেবী দুর্গার শরণ নিলেন। অজ্ঞাতবাস বড় কঠিন সময়। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি আছে নানারকমের দুঃখ। সবচেয়ে বড় যেটা, তা হল - এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম, এই আশঙ্কা। দ্রৌপদীসহ পাণ্ডবরা যখন মৎস্যনগরে ঢুকছেন, তখন মনে মনে যুধিষ্ঠির ত্রিভুবনেশ্বরী দুর্গার স্তুতি করেছিলেন। সেই স্তুতি থেকে জানা যায়, দুর্গার উদ্ভব। দুর্গার জননী মা যশোদা। তিনি যশোদাগর্ভসম্ভূতা। তাঁর পিতা নন্দ।
অত্যাচারী রাজা একদিন দৈববাণী শুনতে পান যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান তাঁকে বধ করবেন। তখন তিনি দেবকী ও তাঁর স্বামী বসুদেবকে মথুরার কারাগারে বন্দি করে রাখেন। বন্দি অবস্থায় তাঁদের ছয়টি সন্তান হয়, এবং প্রত্যেকটি সন্তানকে কংস হত্যা করেন। সপ্তম সন্তান বলরাম দেবকীর গর্ভ থেকে প্রতিস্থাপিত হলেন রোহিণী দেবীর গর্ভে। রোহিণী বসুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী, তিনি থাকেন গোকুলে। ভাদ্রমাসের পূর্ণিমায় বলরামের আবির্ভাব। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে গভীর রাতে কৃষ্ণের আবির্ভাব। সেই শিশুকে পিতা বসুদেব গোপনে নিয়ে যান গোকুলে, নন্দের ঘরে। ওই রাতে যশোদার গর্ভে জন্মান কন্যাসন্তান যোগমায়া। তিনি আসলে দেবী মহাশক্তি।
পুত্রসন্তানকে মা যশোদার কাছে রেখে কন্যাটিকে নিয়ে মথুরায় ফেরেন বসুদেব। যোগমায়াকে দেবকীর ক্রোড়ে দেখতে পান কংস। ভাবেন, এই সন্তান দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত। তখন কংস তাকে শিলাতলে আছাড় মারেন। সদ্যোজাতা আকাশে মিলিয়ে যায়। এই যোগমায়াই দেবী দুর্গা - দিব্যমাল্যবিভূষিতা, দিব্যাম্বরধরা ও খড়্গখেটকধারিণী। তাঁর বর্ণ বালার্কসদৃশ, তাঁর আনন পূর্ণচন্দ্রনিভ এবং তিনি চতুর্ভূজা ও চতুর্ব্বক্ত্রা। আবার তিনি কৃষ্ণবর্ণা ও অষ্টভূজারূপেও পূজিতা হন। তাঁর আট হাতে রয়েছে - বর, অভয়, পানপাত্র, পঙ্কজ, ঘন্টা, পাশ, ধনু ও মহাচক্র। তাঁর কুণ্ডল দিব্য, মাথায় উৎকৃষ্ট কেশবন্ধ ও দিব্য মুকুট। বেণী কটিসূত্র পর্যন্ত লম্বিত। দেবী মহিষাসুরমর্দ্দিনী এবং বিন্ধ্যবাসিনী।
অজ্ঞাতবাসে যুধিষ্ঠির সেই দেবীকে স্মরণ করলেন এবং তাঁর শরণাপন্ন হলেন। যুধিষ্ঠিরের স্তবে তুষ্ট দেবী দুর্গা তাঁকে নির্বিঘ্নে অজ্ঞাতবাসের বর দান করে অন্তর্হিতা হলেন।
মহাভারতের বনপর্বে আছে, সকল প্রকার দুর্গতি থেকে তিনি উদ্ধার করেন বলে তাঁর নাম দুর্গা। তিনি আসলে ভগবতী। বিরাটপর্বে তিনি নন্দগোপকূলজাতা ও যশোদাগর্ভসম্ভূতা। কিন্তু শল্যপর্বে দেবী দুর্গা শৈলপুত্রী, হিমালয়ের কন্যা। মহাভারতের অন্যত্র তিনি মহাদেবের পত্নী। অনুশাসনপর্বের উমামহেশ্বর-সংবাদে সে কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে।
দেবী দুর্গার এই যে আরাধনা, তা শুধু সঙ্কটকালের জন্য। অজ্ঞাতবাসের কঠিন সময়ে যুধিষ্ঠির যেমন দুর্গার শরণ নিয়ে মুক্তি পেলেন, তেমনি আর এক কঠিন সময়ে অর্জুনকে আশ্রয় নিতে হল দেবীর। মহাভারত যাঁরা পড়েছেন বা দেখেছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই জানেন যে ভীষ্মপর্বের শুরুতে অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে এসে চারপাশে স্বজন-বান্ধবদের দেখে যুদ্ধ করতে চাননি। তার পর শ্রীকৃষ্ণ দীর্ঘ উপদেশ দেন অর্জুনকে। যুদ্ধক্ষেত্রে জন্ম হয় শ্রীমদ্ভগবৎগীতা নামক স্মৃতিপ্রস্থানের।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, "তুমি দুর্গার স্তুতি করো"। রথ থেকে নেমে পড়লেন অর্জুন। কৃতাঞ্জলি হয়ে দেবীর স্তুতিগান করলেন। সেই স্তুতিতে দেবী দুর্গা সম্পর্কে জানা যায় - তিনি যোগীদের পরম সিদ্ধিদাত্রী, ব্রহ্মস্বরূপিণী, সৃষ্টি ও প্রলয়ের কারণ, জরামৃত্যুবিহীনা, ভদ্রকালী, বিজয়া, কল্যাণপ্রসূ, মুক্তিস্বরূপা, সাবিত্রী, কালরূপিণী, মোহিনী, কান্তিমতী, পরম সম্পৎ, শ্রী, হ্রী ও জননী। তিনি মহাশক্তি। অর্জুনের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী তাঁকে শত্রুজয়ের বর প্রদান করেন।
দেবী দুর্গার স্বামী মহাদেব, শিব। বনপর্বে আছে, শিবের বাসস্থান কৈলাস পর্বত। তাঁর সহস্রনাম। মজার কথা হলো, মহাভারতের অংশাবতরণ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, অশ্বত্থামা হলেন শিবের অবতার। শতরুদ্রীয় অধ্যায়ে ব্যাসদেব অর্জুনকে বলছেন - তিনি মহোদর, মহাকায়, ত্রিশূলপাণি, পিনাকী, সহস্রাক্ষ প্রভৃতি। তাঁর অনেক পার্ষদ আছেন। তাঁরা জটিল মুণ্ড, বিকৃতানন, বিকৃতপাদ ও বিকৃতবেশ।
দেবী দুর্গার চারজন পুত্রকন্যা। তাঁদের মধ্যে বড় গণেশ হলেন মহাভারতের লেখক। গণেশের জন্ম-উপাখ্যান বড়ই বিচিত্র। গণেশ ছিলেন শূদ্রদের দেবতা, এমন আখ্যান পাওয়া যায়। এক বার শূদ্র ও নারীদের মিছিল দেখে ভয় পেয়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি দেবী দুর্গার শরণ নিলে বিঘ্নেশ্বর গণেশকে সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীকালে ভারতীয় পুরাণের বহু পথ পেরিয়ে সেই গণেশ হয়ে ওঠেন বিঘ্ননাশক। শাস্ত্রে তাই তিনি দ্বিদেহক। তাঁর দুই স্ত্রী - ঋদ্ধি ও সিদ্ধি।
গণেশের ভ্রাতা দেবসেনাপতি কার্তিকেয়। কোথাও তিনি মহাদেবের পুত্র, তাই পার্বতীরও সন্তান। আবার কোথাও অগ্নির পুত্র, তাঁর নাম স্কন্দ। কখনও তাঁর মাতা গঙ্গা বা স্বাহা; কখনও হিমালয়, কাঞ্চনকুণ্ড কিংবা ছয় কৃত্তিকা। বেশ জটিল বিষয়। মহাভারতে আছে, স্কন্দ বা কার্তিকেয় হলেন সহস্রশীর্ষ, অনন্তরূপ, ঋতস্য কর্তা ও সনাতনানামপি শাশ্বত - যে শব্দগুলি পরমব্রহ্মেরই বাচক। কার্তিক বা স্কন্দ শুধু তারকাসুরকে নয়, মহিষাসুরকেও বধ করেছিলেন। দেবতা ‘শ্রী’ হলেন লক্ষ্মী - সর্ববিধ ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী। তিনিই সম্পদ, শুভ আদর্শ। সরস্বতী বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী, তিনি বিদ্যার দেবী। চার বিদ্যা - আন্বীক্ষিকী (যুক্তিশাস্ত্র), ত্রয়ী (তিন বেদ), বার্তা (অর্থবিদ্যা) ও দণ্ডনীতি (রাজনীতি)। তাঁর কাছেও প্রণত হন ভক্তকুল। তিনিই রাজনীতির সৃষ্টি করেছিলেন - 'সসৃজে দণ্ডনীতিং সা ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতা' (শান্তিপর্ব)।
মহাভারত পেরিয়ে বাংলার কৃত্তিবাসী রামায়ণের হাত ধরে দেবীর অকাল বোধন হয় শরৎকালে। ঘুম ভাঙানো হয় সবার। দেবী দুর্গা আসেন ভক্তদের উদ্ধার করতে। ভক্ত কখনও যুধিষ্ঠির, কখনও অর্জুন, কখনও রামচন্দ্র, আবার কখনও স্বয়ং ভগবান। ‘দুর্গা’ কথাটি ‘দুর্গ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। যেখানে সহজে শত্রু প্রবেশ করতে পারে না, তাই দুর্গ। দুর্গ আবার রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গের অন্যতম। দুর্গ মানে হল অশক্যগমন বা অসাধ্যগমন। এক অপরাজেয় দৈত্যের নাম ছিল দুর্গ, যাকে নাশ করেছিলেন দেবী। সেই মহাবিঘ্নাদিনাশিনী দেবী দুর্গা বাঙালির আসন্ন দুর্গতি থেকে উদ্ধার করতে এসেছেন।