আমি মারের সাগর পাড়ি দেব/ বিষম ঝড়ের বায়ে/ আমার ভয়-ভাঙা এই নায়ে।… ইউক্রেন যেন এই মন্ত্রই বুকে করে লড়ে যাচ্ছে। আর ভ্লাদিমির পুতিন, রাশিয়ার সর্বেসর্বা, পুরস্কার দিচ্ছেন। না, সাহিত্যিক বা ক্রীড়াবিদকে পুরস্কার দিচ্ছেন না। রাশিয়ার যে সৈন্যদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে সারা পৃথিবী মুখর, তাদের মরাল-টা যাতে পোক্ত থাকে তার চেষ্টায় তিনি মরিয়া হচ্ছেন বাহিনীকে পুরস্কৃত করে। আমরা ইউক্রেনের বুচায় গণহত্যার কথা বলছি। সেই ছবি দেখে আমরা শিউরে উঠেছিলাম, যে সৈন্যদলের অপ-কীর্তি বলে কীর্তন করছিলাম, সেই বাহিনীকে পুতিন বুকে জড়িয়ে ধরলেন যেন। সেই মিলিটারি ইউনিটের মুকুটে একটি সোনার পালক গুঁজে দিলেন। রাশিয়ার ৬৪তম ডিট্যাচড মোটর রাইফেল ব্রিগেড, যাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় যুদ্ধাপরাধী বলেছে ইউক্রেন, তাদের প্রশংসায় ভরিয়ে পুতিন বলেছেন, গার্ডস। বলেছেন, এই রক্ষীরা রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে। অনেকে 'ধরণী দ্বিধা হও' বললেও, একটু ভাবনাচিন্তা এতে ঢাললেই বোঝা যায়, এটা স্বাভাবিক। কালে কালে এমনই তো হয়ে এসেছে।
কী হয়েছিল বুচায়?
এপ্রিলের শুরুতে, কিয়েভের কাছেপিঠের শহর-শহরতলিগুলি থেকে অন্তত ৪১০ জনের দেহ উদ্ধার করেন ইউক্রেনের সরকারি আধিকারিকরা। এর মধ্যে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতম ছবিটা ছিল বুচার। বুচায় মিলেছিল ৩০০টি দেহ। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, পোড়া নিথর শরীরগুলি দেখে ঘুম চলে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। দেহগুলির মাথার পিছনে ছিল গুলির ফুটো। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভাষণে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধ এটিই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, এই নৃশংসতার জন্য পুতিনের বিচার হবে। ৬৪তম ডিট্যাচড মোটর রাইফেল ব্রিগেডের সদস্যদের নাম, পদ, ছবিও ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক প্রকাশ করেছিল ফেসবুকে।
পুতিনের বক্তব্য কী?
৬৪তম ডিট্যাচড মোটর রাইফেল ব্রিগেডকে গার্ড তকমায় ভূষিত করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। বলেছেন, ইউক্রেনে বিশেষ মিলিটারি অপারেশনে যে সাহসিকতা দেখিয়েছে এই ইউনিট, সে জন্য এই সম্মান। কর্তব্য, নিষ্ঠা, পেশাদারিত্বে এই ইউনিট রোল মডেল, জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট, নির্দ্বিধায়। এবার থেকে এই ইউনিটের নামে গার্ড শব্দটি ঢুকে যাচ্ছে। ৬৪তম গার্ডস ডিট্যাচড মোটর রাইফেল ব্রিগেড, এই হচ্ছে বাহিনীর নতুন নাম।
আরও পড়ুন Explained: বিশ্বের যে কোনও স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম ‘সারমাত’! রুশ ক্ষেপণাস্ত্র সম্পর্কে জানুন
বাহিনীর ইতিহাস
এই বাহিনী আনুষ্ঠানিক ভাবে গঠন করা হয়েছিল ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু এর ইতিহাসে চোখ রাখলে পৌঁছে যেতে হবে ১৯৪১ সালে, মস্কোয় সিটি অফ গোর্কিতে, এখানেই এর আদি রূপের জন্ম হয়েছিল, ৬০তম রিজার্ভ আর্মি, তার নাম ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে বীরদর্পে এই বাহিনী লড়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। এর পর বেশ কয়েক দফা এটির পুনর্গঠন হয়েছে। এখন এই ইউনিটের দফতর নিয়াজ ভোলকোনস্কি গ্রামে।
আরও পড়ুন Explained: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ‘সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক’ তকমার অর্থ কী?
হত্যার কাঠগড়ায় ওঠা বাহিনীকে গার্ড তকমা দিয়ে বিতর্ক তো আরও বহু গুণ বাড়িয়েছেন পুতিন। অনেকে বলছেন, রাষ্ট্রের নির্দেশেই কাজ করে সেনা। রাষ্ট্র নির্দেশ দিলে হত্যা করতে তারা কিছুতেই পিছপা হতে পারে না। এটাই সেনার চরিত্র। তারা তো রাজার হাতের পুতুল, বোড়ে মাত্র। কিন্তু এই সভ্য সময়ে এত বড় একটা নিষ্ঠুরতার জন্য এই ভাবে ঢক্কানিনাদে কোনও বাহিনীকে সম্মান জানানো, পুতিন বিশ্বের যুদ্ধ-বিরোধীদের চোখে অনন্ত অতলেই তলিয়ে গেলেন।