একজনের কাছে যা ধর্ম অন্যজনের কাছে তা কুসংস্কার। অস্ট্রেলিয়ার হাইকোর্ট একটি মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল।
শবরীমালা রায়ের পর্যালোচনা সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারপতির বেঞ্চের কাছে পাঠানো হয়েছে। সংখ্যালঘু বিচারপতিরা যথার্থই বলেছেন, ২০১৮ র রায়ে কোনও রকম গলদের কথা উল্লেখ করা বয়নি, এবং রায়দানের পর কোনও নতুন তথ্যও উঠে আসেনি। যাঁর গত ৯ নভেম্বরের বাবরি রায়ের পর্যালোচনার আবেদনর কথা ভাবছেন তাঁদের শবরীমালা পর্যালোচনার সংখ্যালঘু রায় পড়ে দেখা উচিত।
দুই সংখ্যালঘু বিচারপতি আরেকটি ব্যাপারেও দেশের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে মতবিরোধ প্রকাশ করেছেন। শবরীমালা রিভিউয়ের বিষয়টিকে যেভাবে বোহরা সম্প্রদায়ের নারী লিঙ্গকর্তন, মসজিদে মহিলাদের প্রবেশ এবং আগিয়ারিতে প্রবেশের ব্যাপারে অপারসিদের সঙ্গে বিবাহিতা পারসি মহিলাদের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে জোড়া হয়েছে, সে ব্যাপারে তাঁরা আপত্তি প্রকাশ করেছেন। দুই সংখ্যালঘু মতসম্পন্ন বিচারপতি যথার্থভাবেই দেখিয়েছেন এই মামলা কেবলমাত্র শবরীমলার রায়ের রিভিউমাত্র ছিল, অন্য বিষয়ে কোনও সওয়াল শোনা হয়নি।
আইন ও রাষ্ট্র এ কথা বলতে পারে না এবং বলা উচিতও নয় যে একটি ধর্মের ক্ষেত্রে কী কী অনাবশ্যক। বিতারবিভাগের কাজ মৌলবি বা পুরোহিতের নয়। এই কয়েকদিন আগেই বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে বলা হয়েছে কারও ধর্মীয় বিশ্বাসকে আদালত খুঁটিয়ে দেখতে পারে না। শবরীমালার রায় ও বাবরি রায়ের মধ্য সঙ্গতি নেই- ওই রায়ে পাঁচ বিচারপতি বিতর্কিত স্থানে রামের জন্মসংক্রান্ত হিন্দু বিশ্বাস মেনে নিয়েছে, তখন এ প্রশ্ন করা হয়নি যে হিন্দু ধর্মের অবশ্যপালনীয়গুলির মধ্যে এই বিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত কিনা যে বাবরি মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজের নিচেই রামচন্দ্রের জন্ম। এ কথাও জিজ্ঞাসা কর হয়নি যে এরকম বিশ্বাস না করা সত্ত্বেও কেউ হিন্দু থাকতে পারেন কিনা।
আরও পড়ুন, এক নজরে রাফাল মামলা, কী নিয়ে রিভিউ, কী বলল আদালত
শবরীমালায় অন্য ধর্মাবলম্বীরাও প্রার্থনা করতে যান ফলে, এ কোনও হিন্দু মন্দির নয়, এ আবেদনও বিচারপতি নরিম্যান এবং চন্দ্রচূড় খারিজ করে দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন গির্জায় অন্য ধর্মবলম্বী প্রবেশ করলেও গির্জা গির্জাই থাকে। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের অধিকার খারিজ করে দেওয়ার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট যে যুক্তি দিয়েছিল তা ছিল, বোর্ড এ কথা প্রমাণ করতে পারেনি যে ১৫২৮ থেকে ১৫৫৬ সাল পর্যন্ত যে কেবলমাত্র মুসলিমরাই বাবরিতে প্রার্থনা করত। বৃহস্পতিবারের রায়ের যুক্তিতে দেখলে যদি ভিতরের চবুতরায় কেবলমাত্র মুসলিমরাই নয়, হিন্দুরাও প্রার্থনা করে থাকেন, তাহলে মসজিদের চরিত্র বদল হয় না।
আমাদের সংবিধানে একদিকে যেমন ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা রয়েছে, তেমনই বলা রয়েছে সামাজিক কল্যাণের প্রয়োজনে ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে। ধর্মীয় অনুশীলনের সঙ্গে যুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের অধিকার রাষ্ট্রের হাতে নেই। প্রশ্ন হল, কী করে বোঝা যাবে কোন কার্যকলাপ ধর্মীয় এবং কোনটাই বা ধর্মনিরপেক্ষ। এ প্রশ্নটা জরুরি কারণ বিষয়টি যখন ধর্মীয় তখন আর তাকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
১৯৫৪ সালের শিরুর মঠ মামলায় আদালত বলেছিল সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে একটি ধর্মের অন্তর্নিহিত সমস্ত আচার অনুষ্ঠানই ধর্ম। কোনটি ধর্মের অন্তর্গত এবং কোনটি আবশ্যিক তা স্থির করার দায় ধর্মের উপরেই বর্তায়। এর ফলে অবশ্যপালনীয় আচারের মাধ্যমে ধর্মের সংজ্ঞা স্থির হয়। কিন্তু একটি ধর্মের অবশ্যপালনীয় আচার স্থির করতে গিয়ে বিচারপতিরা তাঁদের বিশেষজ্ঞের অবস্থানকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি খানউইলকর এবং মালহোত্রা শবরীমালার প্রসঙ্গে বলেছেন এই দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক কিনা তা স্থির করবে বৃহত্তর বেঞ্চ। তবে একই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা একইসঙ্গে বলেছেন, সংবিধান নির্দিষ্ট দায়িত্বের জেরে এ বিষয়টি স্থির করা আদালতেরই আওতায় পড়ে।
১৯৫৮ সালে আদালতের সামনে প্রশ্ন উঠেছিল, মন্দিরে প্রবেশের নিষিদ্ধতার মাধ্যমে যে অস্পৃশ্যতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তা হিন্দু ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কিনা। বেশ কিছু হিন্দু নথিপত্র খতিয়ে দেখার পর আদালত রায় দিয়েছিল অস্পৃশ্যতা হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত নয়। শবরীমালার ২০১৮ সালের রায়ে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছিলেন শবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশাধিকার খর্ব করার অর্থ অস্পৃশ্যতা, যা সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। মনে রাখতে হবে, গত বছর তিন মহিলা প্রতীকী ভাবে শবরীমালায় প্রবেশের পর সে মন্দির শুদ্ধ করা হয়েছিল।
মতবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে কী কী ধর্তব্য সে নিয়ে বিভিন্ন আদালত বিভিন্ন সময়ে নানারকম রায় দিয়েছে। যেমন-
* ২০১৪ সালে গ্রাম সভা বাত্তিস শিরালায় একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠাীদাবি করেছিল নাগ পঞ্চমীর দিন জ্যান্ত কেউটে ধরে তার পুজো করা তাদের ধর্মে অবশ্যপালনীয়। তারা শ্রীনাথ লীলামৃতে বিশ্বাসী। বম্বে হাইকোর্ট তাদের দাবি খারিজ করে দেয় বৃহত্তর ধর্মশাস্ত্রের সাপেক্ষে। একটি গ্রামের বাসিন্দাদের নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থে আস্থা রাখার বিষয়টি আদালত গ্রাহ্য করেনি। শবরীমালার ক্ষেত্রেও আয়াপ্পা ভক্তদের বিশ্বাসকে গুরুত্ব না দিয়ে বৃহত্তর হিন্দুদের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেছে আদালত। তাদের আলাদা হিন্দু গোষ্ঠী বলে স্বীকার করা হয়নি।
* কেরালা হাইকোর্টে এক মুসলিম পুলিশ অফিসার দাড়ি না রাখার আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আবেদন করেছিলেন। আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করে দেয়। আদালতের বক্তব্য ছিল অনেক মুসলিম বিশিষ্টজন রয়েছেন, যাঁরা দাড়ি রাখেন না এবং এর আগে চাকরি করার সময়ে আবেদনকারী দাড়ি রাখেননি। এ ব্যাপারে আদালত সাধারণ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেছিল, তখন ধর্মগ্রন্থকে ধরা হয়নি। তবে অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণ সত্ত্বেও হিন্দুদের বলিপ্রথাকে বর্বরোচিত বলে আদালত তা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।
* তাণ্ডব নাচ মামলায় শীর্ষ আদালত পূর্বসূরীদের মতবাদের উপর নির্ভর করে জানিয়ে দেয় এই নাচ আনন্দমার্গের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়। এও বলা হয় যে এই বিশ্বাসের শুরু ১৯৫৫ সালে, আর তাণ্ডব নাচ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৯৬৬ সালে। ফলে তাণ্ডব নৃত্য ছাড়াও এ ধর্মবিশ্বাসের অস্তিত্ব ছিল, বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে তাণ্ডব নাচকে ধরা যায় না। কোনও ধর্মীয় বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সময়ের সঙ্গে শীলিভূত হয়ে যাবে এ যুক্তি অতীব বিস্ময়কর।
* ১৯৯৪ সালের ইসমাইল ফারুকি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রশ্ন আসে বাবরি মসজিদের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে। সেখানে মূল বিষয় ছেড়ে আদালত চলে যায় মসজিদে নমাজ পাঠ ইসলামের অবশ্যপালনীয় কিনা সে বিচার করতে। আদালত রায় দেয় নমাজ পাঠ যেহেতু ধর্মাচরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, নমাজ পাঠ না হলে তার মসজিদ নয়।
জমায়েত হয়ে প্রার্থনা যে ইসলামের কেন্দ্রীয় বিষয় তা সুবিদিত এবং মসজিদের মূল উদ্দেশ্যও তাই। ২০১৮ সালে আদালত এই উদ্ভট রায়ের রিভিউয়ের আবেদন খারিজ করে দেয়। তবে শবরীমালা মামলায় অবিচ্ছেদ্যতার বিষয়টি নিয়ে যে পর্যালোচনা প্রয়োজন সে বিষয়ে তারা সহমত হয়।
নিজের বিচারবুদ্ধি ও বিবেক অনুসারে ধর্মবিশ্বাস পালন যে মৌলিক অধিকার সে কথা সু্প্রিম কোর্ট স্বীকার করে নিয়েছে। ফলে এ বিষয়টি ব্যক্তির অধিকার, গোষ্ঠীর অধিকার নয়। অবশ্যপালনীয় আচারের পরীক্ষা ব্যক্তির অধিকারের ধারণার পরিপন্থী। এই পরীক্ষার আওতায় আদালত কিছু ধর্মাচরণকে অন্য ধর্মাচরণের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, অথচ কোনও ধর্মের কোন আচার বা অনুষ্ঠান আবশ্যিক বা অনাবশ্যিক সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার বিশেষ জ্ঞান তার অনধিকৃত। এগুলি সম্পূর্ণই আধ্যাত্মিক বিষয়।
উপরিউক্ত মামলাগুলি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বিচারবিভাগ তার নিজস্ব যুক্তিবোধ ও নৈতিকতার ধরাণা অনুসারে ধর্মসংস্কারকের ভূমিকা পালন করে থাকে। অবশ্যপালনীয় আচার অনুষ্ঠানের পরীক্ষার ব্যাপারে জোর দেবার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতার ভিত্তিকেই আঘাত করেছে। হিন্দুত্বের আচারঅনুষ্ঠানকে টার্গেট করেছেন সেই সব সংস্কারক বিচারপতিরা যাঁরা মনে করেন এগুলি কুসংস্কারের ভিত্তিতে তৈরি, অন্যদিকে ইসলামের মূল আচার অনুষ্ঠানকে টার্গেট করা হচ্ছে হয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সেন্টিমেন্টকে মাথায় রেখে, নয়ত ইসলামি আচারআচরণ সম্পর্কে ভুল ধারণার জায়গা থেকে।
ধর্মের যে যে বিষয়গুলিকে আদালত আবশ্যিক বলে মনে করছে, সেগুলিকে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দেওয়ার ধারণাটি সমস্যার। একটি ধর্মের একটি উপাদান বা আচার অন্য উপাদান বা আচার নিরপেক্ষ বা একটি ধর্মের কোনও একটি বিষয় কেন্দ্রীয় আর অন্যগুলি সামান্য, এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উপরোক্ত ধারণা তৈরি হয়ে থাকে।
(ফৈজান মুস্তাফা নালসার আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তথা সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ)