রাজা অ্যাকাডেমি। নাম ক'জনই বা শুনেছে! মুম্বইয়ের ছোট একটি অফিস থেকে চালিত এই একাডেমিই এখন আলোচনায়। ত্রিপুরার সাম্প্রদায়িক হিংসার স্ফূলিঙ্গ পড়ে মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে অশান্তির আগুন, তারই সৌজন্যে এই 'রাজা' শিরোনামে। প্রথমে, ত্রিপুরার ঘটনার প্রতিবাদে অ্যাকাডেমির বিক্ষোভ থেকে পাথর ছোড়াছুড়ি। এর বিরুদ্ধে আবার বিজেপির ডাকা বন্ ধে গাড়িতে আগুন, মুসলিমদের কয়েকটি দোকান পোড়ানোয় পরিস্থিতি জটিলতর। এর আগে, ২০১২ সালে, রাজা অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সইদ নুরির নেতৃত্বে আজাদ ময়দানের বিক্ষোভেও অশান্তি হয়েছিল তীব্র। শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউত অবশ্য সংগঠনটিকে বিজেপি মদতপুষ্ট বলে দাগিয়েছেন। কিন্তু এ সব কিছু কেন? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাতেই বিশ্লেষণের আলো ফেলেছে।
কবে রাজা অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠা এবং কেন?
রাজা অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠা ১৯৭৮ সালে। আহমেদ সইদ নুরির হাতে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত নুরিই এই সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট। কেন এ সংগঠনের গঠন? সুন্নিদের বারেলভি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ রাজা খান বারেলভির লেখা বইপত্র প্রকাশের জন্য প্রাথমিক ভাবে এটি তৈরি হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় বারেলভিদের এই সম্প্রদায় বেড়ে ওঠে ১৮৭০ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে। সংস্কারবাদী দেওবন্দি এবং সলাফি আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন বারেলভিরা।
রাজা অ্যাকাডেমির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এদের কাজ 'সংখ্যালঘুদের মধ্যে শিক্ষা-সচেতনতার প্রসার। সংখ্য়ালঘুরা আক্রান্ত হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে' গর্জানো। এর অফিস রয়েছে দক্ষিণ মুম্বইয়ের মহম্মদ আলি রোডে।
সইদ নুরি কে?
সুতোর ব্যবসায় কাজ করতে করতে সুন্নি ইসলামের স্বার্থে নুরি তৈরি করেন রাজা একাডেমি। এমনই দাবি করা হয়। তাঁর কোনও প্রথাগত ধর্মীয় শিক্ষা নেই। এই একাডেমির সঙ্গেও প্রথাগত শিক্ষা-দীক্ষা জড়িয়ে নেই। কিন্তু নানা সময়ে বিভিন্ন প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে এটি পরিচিতি তৈরি করেছে। বিভিন্ন শহরের মুসলিমরা এই সব প্রতিবাদে অংশও নিয়েছেন।
অমরাবতীর হিংসায় কী ভাবে সংগঠন শিরোনামে?
ত্রিপুরার ঘটনায় অমরাবতী, মালেগাঁও, অকোলা সহ মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে মুসলিমরা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেছেন। অমরাবতীতে শুক্রবারের নমাজের পর প্রতিবাদে মিছিলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায় রাজা অ্যাকাডেমি। অভিযোগ, মিছিল থেকে এক বিজেপি নেতার বাড়িতে পাথর ছোড়া হয়, জানালার কাচ ভাঙে তাতে। একজন আহতও হন। এর পর শনিবার বিজেপি বন্ ধ ডাকে অমরাবতীতে। গেরুয়া ব্রিগেডের ৬ হাজারের বেশি কর্মী বনধ করতে মাঠে নামে। মুসলিমদের কিছু দোকানে আগুন লাগানো হয় বলেও অভিযোগ।
আরও পড়ুন ভাঙচুর-সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা, কী হচ্ছে ত্রিপুরায় এবং কেন?
এর পর শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউতের বিস্ফোরক মন্তব্য, 'রাজা অ্যাকাডেমি বিজেপি মদতপুষ্ট সংগঠন।' রাউতের অভিযোগ, 'এই সংগঠন বহু বছর ধরে বিজেপিকে সাহায্য করে চলেছে।' নুরিকেও এ ব্যাপারে ফোন করা হয়। তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ফোন তোলেননি।
নানা বিতর্কে রাজা অ্যাকাডেমি
১৯৯৯ সালে ভারত সরকার সলমন রুশদিকে এ দেশে আসার জন্য ভিসা দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামে রাজা। রুশদির স্যাটনিক ভার্সেস ফতোয়া জারি করে তারা। মুম্বইয়ে রুশদির কুশপুতুল পোড়ায় রাজা-র লোকজন। একাডেমির টার্গেট আরও এক সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন। ২০০০ সালে এই বাংলাদেশি লেখিকা মুম্বইয়ে এলে রাজা প্রতিবাদে মুখর হয়। তসলিমাকে নিয়ে অনুষ্ঠান ভন্ডুল করার চেষ্টা চালায়। বিবিসি তাদের ভিডিওয় হজরত মহম্মদের ছবি ব্যবহার করে কোপে পড়ে এই অ্যাকাডেমির। ২০১৫ সালে মিউজিক কম্পোজার এ আর রহমান এবং ইরানের পরিচালক মাজিদ মাজিদির বিরুদ্ধেও ফুঁসে ওঠে তারা। তাঁদের বিরুদ্ধে রাজা ফতোয়া জারি করে। কারণটা হল মাজিদ মাজিদির সিনেমা-- মুহম্মদ: মেসেঞ্জার অফ গড। ছবিটিতে সুর দিয়েছেন রহমান। শুধু বিতর্কই নয়, কিছু সামাজিক কাজেও দেখা গিয়েছে এই অ্যাকাডেমি। কোভিডে মৃত মুসলিমদের কবরস্থ করার কাজে বিএমসি-র ছাড়পত্র পেয়েছিল এটি। অ্যাকাডেমির দাবি, তারা ২০১৮-এ কেরলের বন্যায় ত্রাণের হাত বাড়িয়েছিল।
২০১২-এ আজাদ ময়দানে হিংসা ও রাজা একাডেমি
২০১২ সালের ১১ অগস্ট। রাজা অ্যাকাডেমি এবং মেদিনাতুল্লা ফাউন্ডেশন আজাদ ময়দানে যৌথ প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দেয়। কিসের প্রতিবাদ? অভিযোগ উঠেছিল, অসম এবং মায়ানমারে মুসলিমদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হিংসাত্মক চেহারা নেয়। প্রবল ইটবর্ষণ চলে। ফলাফল দু'জনের মৃত্যু। এবং আহতের সংখ্যা ৬০ ছাড়ায়। আহতদের মধ্যে ছিলেন পুলিশকর্মীরাও। সম্পত্তির ক্ষতি হয় ২ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকার। দুই সংগঠনকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলাও হয়। যদিও সেই কর্মসূচির উদ্যোগে ভূমিকার কথা অস্বীকার করেন নুরি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন