COVID-19 এর বাড়তে থাকা দাপটের ফলে বিগত বছর দুয়েক ধরে ক্রমশ মন্থর হতে থাকা ভারতীয় অর্থনীতি এবার একেবারেই অচল হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ ভবিষ্যদ্বাণীই বলছে, ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDP বা gross domestic product) চলতি আর্থিক বর্ষে একরকম বাড়বে না বললেই চলে - বরং কমার আশঙ্কা রয়েছে, পৃথিবীর বেশিরভাগ বড় দেশের অর্থনীতির মতোই।
এই পতনের কারণ কী? দেশব্যাপী লকডাউনের ফলে কমেছে আয়, স্বাভাবিকভাবেই কমেছে ব্যয়ও। সোজা কথায়, যে কোনও বস্তুর চাহিদা, সে পিৎজা হোক বা গাড়ি, অথবা চুল কাটা বা বিদেশ ভ্রমণের মতো পরিষেবার চাহিদারও পতন ঘটেছে।
চাহিদা বাড়াতে কী করা যায়? মানুষের কাছে টাকা থাকা দরকার। কিন্তু সেই টাকা দেবে কে? কোম্পানির সিইও থেকে শুরু করে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিক, সকলেরই আয় কমেছে বিপুল হারে, যদি না একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: করোনার জন্য কি ভারতীয় অর্থনীতি মার খাচ্ছে?
কে কী করছে?
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার মতো করে অর্থব্যবস্থায় নগদের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকারি বন্ড কিনেছে যাতে অর্থব্যবস্থায় নগদের সঞ্চার ঘটে। তবে অধিকাংশ ব্যাঙ্কই ঝুঁকি নিতে চাইছে না, ফলে তারা নতুন ঋণের অনুমোদন দিতে অনিচ্ছুক। তাছাড়াও এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ।
এই সঙ্কট উপস্থিত হওয়ার আগেই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল ভারত সরকারের আর্থিক অবস্থা, এবং আর্থিক ঘাটতি (আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সমতা আনতে মোট ঋণের পরিমাণ) ছিল বিপদসীমার অনেকটাই ওপরে। এখন যা অবস্থা, তাতে আর কোনও বিপর্যয় না ঘটলেও অর্থনীতি অচল হয়ে পড়ার ফলে সরকারের রাজস্ব বন্ধ, অতএব 'সাধারণ' সরকারের (অর্থাৎ কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার) আর্থিক ঘাটতির হার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যেখানে অনুমোদিত হার স্রেফ ৬ শতাংশ। তার ওপর যদি কোনোরকম ত্রাণ প্যাকেজ দিতে হয়, তবে বিপুল অঙ্কের টাকা ধার করতে হবে, যাতে ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে আর্থিক ঘাটতির হার।
তাছাড়াও, সরকারকে ধার করতে হলেও তো বাজারে টাকা থাকতে হবে সঞ্চয় হিসেবে। পরিসংখ্যান বলছে, গৃহস্থের সঞ্চয় পড়তির দিকে, এবং বর্তমানে তা দিয়ে সরকারের প্রয়োজন টায়ে টায়ে মিটবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ভারতীয় অর্থনীতি থেকে সরে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অপেক্ষাকৃত 'নিরাপদ' অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছে, এবং এই অনিশ্চয়তার সময়ে ঋণ দিতে অনিচ্ছুক তারাও। সুতরাং সরকারের ধার করার মতো যথেষ্ট অর্থ বাজারে মজুত নেই। তাছাড়া বাজার থেকে যত বেশি ধার করবে সরকার, ততই বাড়তে থাকবে সুদের হার।
স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কাঠামো মেনে চললে, পরিস্থিতি ভালো হওয়ার আগে আরও খারাপ হবে। এবং সেই ভালো হওয়ার প্রক্রিয়াও হবে অত্যন্ত মন্থর, এবং কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, সন্তানদের শিক্ষায় বাধা আসবে, খেতে পাবেন না বহু মানুষ, ইত্যাদি প্রভৃতি।
তবে একটা সমাধা আছে - সরকারি ঘাটতির 'সরাসরি' মুদ্রীকরণ।
আরও পড়ুন: ভারতে সরাসরি বিদেশি লগ্নি নীতিতে বদল কেন, তাতে চিনই বা অসন্তুষ্ট কেন?
কী এই সরাসরি মুদ্রীকরণ?
এমন এক পরিস্থিতির কল্পনা করুন, যেখানে সরকার সরাসরি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে লেনদেন করছে - আর্থিক ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে - এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে বলছে সরকারি বন্ড-এর বিনিময়ে টাকা ছাপতে। এর ফলে সরকারের হাতে নগদ টাকা আসছে, যা দিয়ে পীড়িত অর্থনীতির ভার কিছুটা লাঘব হয়, সে সরাসরি গরীবদের হাতে টাকা পৌঁছে দিয়েই হোক, বা হাসপাতাল নির্মাণ করে হোক, বা ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোগের কর্মীদের বেতন ভাতা দিয়েই হোক।
এই টাকা ছাপানোর যে আর্থিক দায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিল (মনে রাখবেন, প্রতিটি নোটে ছাপার অক্ষরে লেখা থাকে সেই নোটের বাহককে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের নির্দিষ্ট টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি), তার পরিবর্তে তারা পেল সরকারি বন্ড, যা কিনা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে, যেহেতু এই বন্ড হলো আগামীতে সরকারের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। এবং যেহেতু সরকার কথার খেলাপ করবে না বলে ধরে নেওয়া যায়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শিট-এও এই বিষয়ে কোনও সমস্যা থাকবে না, ওদিকে সরকার অর্থনীতিকে 'রিবুট' করার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে।
এই মুদ্রীকরণের সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের 'পরোক্ষ' মুদ্রীকরণ, যেমন তথাকথিত 'ওপেন মার্কেট অপারেশনস' এবং/অথবা সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ড কেনার প্রভেদ রয়েছে।
অন্যান্য দেশেও কি COVID-19 জনিত অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে নোট ছাপা হচ্ছে?
হ্যাঁ হচ্ছে। গত ৯ এপ্রিল ব্রিটেনের সরকারকে সরাসরি মুদ্রীকরণের সুবিধা দেয় ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড, যদিও ব্যাঙ্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই পদক্ষেপের বিপক্ষে ছিলেন।
আরও পড়ুন: কেবল অশোধিত তেল নয়, চিনির বাজারেও দুর্বিপাক
ভারতে এর আগে কখনও এমনটা হয়েছে?
হ্যাঁ, ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সরকারের আর্থিক ঘাটতি "স্বয়ংক্রিয়ভাবে" মিটিয়ে এসেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তবে সরকারি ঘাটতির সরাসরি মুদ্রীকরণের কিছু নেতিবাচক দিক আছে বটেই। ১৯৯৪ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ডাঃ মনমোহন সিং (যিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নরও), এবং তৎকালীন গভর্নর সি রঙ্গরাজন সিদ্ধান্ত নেন, ১৯৯৭ সালের মধ্যে এই প্রথার অবসান হবে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে রঙ্গরাজনও মনে করছেন, আর্থিক ঘাটতির মুদ্রীকরণ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই ভারতের। সম্প্রতি তিনি বলেন, "ঘাটতির মুদ্রীকরণ অবধারিত। এত বেশি পরিমাণে ব্যয়বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সরকারের ঋণ মুদ্রীকরণ করা ছাড়া গতি নেই।"
তাহলে সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে নতুন নোট ছাপতে বলছে না কেন?
এর মূল কারণ হলো, আর্থিক ঘাটতির সরাসরি মুদ্রীকরণ একটি বহু বিতর্কিত বিষয়। সম্প্রতি এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আরও এক প্রাক্তন গভর্নর, ডি সুব্বারাও। 'ফিনান্সিয়াল টাইমস' পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, "এই সঙ্কটের সময়ে যে ভারতকে আরও বেশি ঋণ এবং ব্যয় করতে হবে, তা প্রশ্নাতীত; এটি নৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে বাধ্যতামূলক; তবে নয়া দিল্লি যেন ভুলে না যায় যে ১৯৯১-এর রক্তক্ষয়ী বিনিময় ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস) সঙ্কট, এবং ২০১৩-র প্রায় সঙ্কটের মূলে ছিল দীর্ঘদিনের আর্থিক অপব্যয়িতা।"
সরকারি আর্থিক ঘাটতির সরাসরি মুদ্রীকরণের প্রধান সমস্যা কী কী?
এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রধান যুক্তি তার শুরুটা নিয়ে অতটা নয়, তবে শেষটা নিয়ে বটে। আদর্শ পরিস্থিতিতে এই হাতিয়ার ব্যবহার করে বেসরকারি চাহিদা কমতে থাকলে সার্বিকভাবে চাহিদা বাড়াতে পারে সরকার, যেমন এখন হয়েছে। তবে ঠিক সময় এই রাস্তা থেকে সরে না এলে অন্যরকম সঙ্কটের বীজ রোপিত হওয়ার সম্ভাবনা।
সেই সঙ্কট এই প্রকার: নতুন নোট ব্যবহার করে সাধারণের আয় বাড়িয়ে দিয়ে অর্থনীতিতে ফের চাহিদার সঞ্চার করল সরকার। এর ফলে বাড়ল মুদ্রাস্ফীতি। ব্যবসায়িক কার্যকলাপ বাড়াতে কিছুটা মুদ্রাস্ফীতি হলে ক্ষতি নেই। তবে ঠিক সময়ে না থামলে বাজারে নগদের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে, ফলত মুদ্রাস্ফীতিও বাড়বে দ্রুত। এবং যেহেতু একটা সময়ের আগে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব বোঝা যায় না, যতক্ষণে সরকার টের পায় যে তারা বেশি টাকা ধার নিয়ে ফেলেছে, ,ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। বাড়ন্ত মুদ্রাস্ফীতি এবং অতিরিক্ত সরকারি ঋণ বৃহত্তর অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দেয়, যেমন বলেছেন সুব্বারাও।
আরও পড়ুন: তেল কিনলে ডলার মিলছে, এমন ঐতিহাসিক পরিস্থিতি হল কী করে?
সরকারি ঋণ কোন স্তর পর্যন্ত সীমিত থাকা উচিত?
সরকারি ঋণের কোনও পাথরে খোদাই করা আদর্শ স্তর নেই (গ্রাফ দেখলে বুঝবেন ব্রিটেনে সরকারি ঋণ তিন শতক ধরে কীভাবে ওঠাপড়া করেছে), তবে অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ভারতের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এই ঋণের হার জিডিপি-র ৮০ থেক ৯০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। বর্তমানে ভারতে এই হার আনুমানিক ৭০ শতাংশ।
সুব্বারাও লিখেছেন, "ভারতের উচিত পূর্ব-নির্ধারিত একটি অঙ্কের টাকা অতিরিক্ত ঋণ হিসেবে নেওয়া, এবং সঙ্কট কেটে গেলে সেই অর্থ ফেরত দেওয়া। একমাত্র এই ধরনের প্রকাশ্য আর্থিক সংযমই কোনও উঠতি অর্থনীতিতে ভরসার সঞ্চার করতে পারে।"
সরাসরি মুদ্রীকরণের বিরুদ্ধে আরও একটি যুক্তি হলো যে সরকার স্বভাবতই অকর্মণ্য এবং খরচের বিষয়ে দুর্নীতিপরায়ণ - উদাহরণ, কাকে কতটা পরিমাণে আর্থিক ত্রাণ বণ্টন করা হবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন