খালি চোখে দেখলে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোয় যে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে তার কোনও মানে হয় না। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম ধনী শহরের বাসিন্দারা (মাথাপিছু গড় আয় ১৫ হাজার ডলার, যেখানে ভারতের মাথাপিছু গড় আয় ২১০০ ডলার) কেন তাদের দৈনন্দিন জীবনের সব কিছু ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় নেমে বিদ্রোহ শুরু করে দেবে শুধু গণপরিবহণের ভাড়া মাত্র ৪ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে?
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে গত ১৮ অক্টোবর সান্তিয়াগোয় জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়, এবং বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা অন্য বেশ কিছু শহরেও লাগু করা হয়। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়েছে এবং মৃতের সংখ্যা দু অঙ্কে পৌঁছিয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক অতীতে হিংসাত্মক বিদ্রোহ কিন্তু সান্তিয়াগোতেই প্রথম হল না। গত বছরের নভেম্বর মাসে প্যারিসে হলুদ গেঞ্জি বিদ্রোহ ব্যাপক আকার নিয়েছিল জ্বালানির উপর করের হার ২০ শতাংশ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হলুদ গেঞ্জি বিদ্রোহ প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বিরুদ্ধে বর্শামুখে পরিণত হয়েছে। ভুললে চলবে না হংকংয়ের চলমান বিদ্রোহের কথাও যা শুরু হয়েছিল প্রত্যর্পণ আইনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দিয়ে কিন্তু ক্রমাগত যা গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এবং সে পরিসর ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতার সীমানায় উপস্থিত হয়েছে, যেখানে তারা বিশ্বের দুই বৃহৎ শক্তিধর অর্থনীতি আমেরিকা ও চিনের বিরুদ্ধাচরণ করছে। প্যারিস (মাথাপিছু জাতীয় আয় ৪৩,৫০০ ডলারের বেশি) এবং হংকং (মাথাপিছু জাতীয় আয় ৩৮,৫০০ ডলারের বেশি) এ দুই শহরই দুনিয়ার ধনীতম শহরগুলির অন্যতম।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: সহজে ব্যবসা- ভারত কী করে উঠে এল ৬৩ নম্বরে
সান্তিয়াগো বিক্ষোভ চিলি ছাড়িয়ে কতদূর প্রভাব বিস্তার করবে তা বলা মুশকিল, তবে এ সমস্ত ঘটনাই একটি প্রশ্ন বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে। তা হল অপেক্ষাকৃত ধনী শহরগুলি ক্রমশ হিংসা এবং তাৎক্ষণিক বিদ্রোহের হটস্পট হয়ে উঠছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ্রি সাচস গত ২২ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের ধারণা এবং স্বাধীনতাহীনতার বোধ এই শহরগুলির বাসিন্দাদের বিক্ষোভের কারণ হতে পারে।
"হংকংয়ে গড় বেতনের তুলনায় সম্পত্তির দাম পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। উচ্চ আয়ভুক্ত দেশের সংগঠন ওইসিডি ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে চিলিতে আয়ের অসাম্য সবচেয়ে বেশি। ফ্রান্সে এলিট পরিবারের ছেলেমেয়েরা ব্যাপক সুবিধা পেয়ে থাকে", লিখছেন তিনি। "বাড়িঘরের অতিরিক্ত দামের ফলে বেশির বাগ মানুষ মূল বাণিজ্য এলাকার বাইরে বাস করতে বাধ্য হন এবং কাজে যাওয়ার জন্য তাঁদের নিজেদের গাড়ি বা গণপরিবহণের ওপরেই ভরসা করতে হয়। ফলে যাতায়াতের খরচে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁরা বেশি সংবেদনশীল যা প্যারিস ও সান্তিয়াগোর বিক্ষোভ থেকে উঠে এসেছে।"
তিনি আরও বলেন, "এই তিনটি শহরেই সরকার বিক্ষোভের ব্যাপারে কিছু বুঝতে পারেনি কারণ তারা মানুষের ভাবাবেগ সম্পর্কে অসচেতন এবং গণপরিষেবায় লগ্নি করার প্রয়োজনীয়তাকে খাটো করে দেখে এবং ধনীদের সম্পদ দরিদ্রদের কাছে বিতরণ করার বিষয়টি নিয়ে ভাবে না।" তিনি লিখেছেন, "সমস্ত সমাজেরই উচিত জনগণের কথা আত্মস্থ করা এবং সামাজিক অসন্তোষ ও বিশ্বাসহীনতার উৎসগুলির দিকে নজর দেওয়া। ন্যায্যতা এবং পরিবেশবান্ধব ভাবনা ছাড়া কোনওরকম আর্থিক বৃদ্ধি বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে উঠবে, সুসার আনবে না।"