রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফেরানোর সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার দায়ভার মায়ানমারের উপর চাপিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার বাংলাদেশের সংসদে তিনি বলেন, "আমরা দেখলাম দেশে সসম্মানে ফেরার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি মায়ানমার।"
দু সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাঁদের মায়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য নির্ধারিত বাসে উঠতে অস্বীকার করেন। এর ফলে ২০১৯-এর অগাস্টে রোহিঙ্গা প্রত্যর্পণ নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হল মায়ানমার। এর আগে ২০১৮ সালেও তারা এই ব্যর্থতার মুখে পড়েছিল। সেবার বাংলাদেশ প্রত্যর্পণের পরিকল্পনা পিছিয়ে দেয়।
প্রত্যর্পণের লক্ষ্যমাত্রা
রাষ্ট্রসংঘের হিসাব অনুসারে ২০১৭ সালের অগাস্ট মাস থেকে ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা মায়ানমার থেকে পালিয়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশের কক্সবাজারে সে দেশের সরকার তাঁদের জন্য দুটি শিবির বানিয়ে দিয়েছে। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে আলাপ আলোচনার পর বাংলাদেশ ঘোষণা করে যে রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের একটি যৌথ দল প্রত্যর্পণের শর্ত স্থির করবে যা ২০১৯ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হবে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ প্রত্যর্পণের জন্য ৮০০০ শরণার্থীর একটি তালিকা পেশ করে, কিন্তু মায়ানমার তাদের মধ্যে মাত্র ৩৭৪ জনকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জানায়। বাকিদের নথিপত্র অসম্পূর্ণ বলে জানায় মায়ানমার সরকার। ২০১৮ সালের মে মাসে মায়ানমার ঘোষণা করে ১১০০ নথিভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেবে তারা।
আরও পড়ুন, প্রতি বছর কেন নতুন আই ফোন বাজারে আনে অ্যাপেল?
২০১৮ সালের জুন মাসে মায়ানমার এবং রাষ্ট্রসংঘ একটি গোপন মউ (মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং) স্বাক্ষর করে। সে মউ অনলাইনে ফাঁস হবার পর শরণার্থীরা তা মানতে অস্বীকার করেন। বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক কর্মী কো কো লিন গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছি যে আমাদের ফেরার আগে আমাদের নাগরিকত্বের অধিকার বার্মা সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু মউতে নাগরিকত্বের ইস্যুটি ওঁরা এড়িয়ে গিয়েছেন..."
২০১৮ সালে রয়টার্স একটি শরণার্থী শিবিরের বয়স্ক রোহিঙ্গাদের দাবির একটি তালিকা প্রকাশ করে। তাঁদের দাবি ছিল মায়ানমার সরকারকে শরণার্থীদের নাগরিকত্বের কথা স্বীকার করতে হবে, তাঁদের জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, থাঁদের একদা অধিকৃত জমি ফিরিয়ে দিতে হবে, তাঁদের বাড়ি, স্কুল ও মসজিদ পুনর্গঠন করে দিতে হবে, এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য মায়ানমার সামরিকবাহিনীর বিচার করতে হবে।
ব্যর্থ প্রত্যর্পণ
ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকা বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে উদ্ধৃত করেছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ও মায়ানমার উভয়েই প্রত্যর্পণ ফের শুরু করতে রাজি "কিন্তু কিছু রোহিঙ্গা নেতা ও এনজিও তাঁদের ফেরার ব্যাপারে নিরুৎসাহ করছে। চারটি শরণার্থী পরিবারের ১৮জন যখন বাসে উঠতে গিয়েছিলেন, সে সময়ে অন্য শরণার্থীরা তাঁদের নিরস্ত করে বলেন তাঁরা নিজেদের গ্রামে ফিরতে পারবেন না বা নাগরিকত্ব পাবেন না।" ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে বলেছে, "এখনও পর্যন্ত যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁরা কেউই এই মুহূর্তে প্রত্যর্পণে আগ্রহী নন। এ ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করে চলবে..."
সংকটের উৎস
রোহিঙ্গারা হল মায়ানমারের বাংলাভাষী মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যাদের সে দেশের সরকার বাংলাদেশ থেকে আগত বেআইনি অভিবাসী বলে মনে করে এবং বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন ১৯৭২ অনুসারে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। রোহিঙ্গারা মূলত বাস করেন মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে, যা একদা (১৪২৯-১৯৭৫) আরাকান রাজত্বের অংশ ছিল। এর মধ্যে পড়ত অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামও।
আরও পড়ুন, রাষ্ট্র সংঘে যখন ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মায়ানমার সীমান্ত পুলিশের উপর হামলার ঘটনাবলীর পর শরণার্থী সংকট বাড়তে থাকে। এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি। সামরিক বাহিনীর প্রত্যাঘাতের সময়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গা গ্রামবাসী নিহত হন, তাঁদের ধর্ষণ করা হয় এবং বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে জেলে পাঠানো হয় বলেও অভিযোগ। মানবাধিকার সংগঠনগুলির অভিযোগ, পালানোর সময়েও রোহিঙ্গাদের ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মায়ানমার সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করেছেন তাঁরা।
রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশ
২০১৭ সাল থেকে উদ্বাস্তু শিবিরের জন্য ৪৩০০ একর পাহাড় ও বনভূমি নষ্ট করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডেলি স্টার। ১৩৪৫ হেক্টর এলাকার বনভূমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা।
২০১৯ সালের মার্চ মাসে রয়টার্স প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, "বাংলাদেশ শরণার্থী আগমনের বৃদ্ধির সমস্যার সঙ্গে যোঝার চেষ্টা করছে এবং রাষ্ট্রসংঘের সহায়তায় বঙ্গোপসাগরের ভাসান চরে তাঁদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে।" শরণার্থীরা পুনর্বাসনে রাজি না হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
রাষ্ট্রসংঘ ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যাচ্ছে শিবির গুলির অবস্থাও ভাল নয়। সেখানে হিংসা, মারামারি এমনকি অপহরণের ঘটনাও ঘটাচ্ছে রোহিঙ্গারা নিজেরাই। শিবিরে পুলিশ প্রহরা বাড়াতে হয়েছে বাংসাদেশ সরকারকে। মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, রোহিঙ্গা মহিলাদের বিভিন্ন দেশে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে অথবা তাঁদের বাংলাদেশে দেহব্যবসায়ে যোগ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
Read the Full Story in English