দশেরা উপলক্ষে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেন, ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্র। এর পরেই অকাল তখতের জাঠেদার গিয়ানী হরপ্রীত সিং এবং শিরোমণি গুরুদোয়ারা প্রবন্ধ কমিটির প্রেসিডেন্ট গোবিন্দ সিং লঙ্গোয়াল সহ শিখ সম্প্রদায়ের নেতারা এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। শিখদের নিয়ে আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সে সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন ভাবে গড়িয়েছে, তা দেখে নেওয়া যাক।
আর্য সমাজ, শিখ এবং আরএসএস
ইতিহাসবিদ ডক্টর গান্ডা সিং তাঁর গবেষণায় লিখেছেন, "হিন্দু-শিখ অনৈক্যের কথা ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি শিখ শাসনের সময়কালে অজানা ছিল।"
১৮৭৫ সালে আর্যসমাজ সত্যার্থ প্রকাশ নামে একটি বই প্রকাশ করে। শিখরা মনে করেন সেখানে শিখ গুরুদের সম্পর্কে মানহানিকর কথা লেখা হয়েছিল। এর পর শুরু হয় শিখ সভা আন্দোলন, যে আন্দোলনে এই উল্লেখের বিরোধিতা করার সঙ্গে সঙ্গে শিখ সম্প্রদায়ের আত্মপরিচয়কে পৃথক রূপে প্রতিষ্ঠিত করার বৃহত্তর লক্ষ্য নেওয়া হয়।
শিরোমণি গুরুদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটি (এসজিপিসি) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালে। এখানে "শিখ কে" তা নির্দিষ্ট করা হয়, শিখ রেহাত মর্যাদা বিধি গৃহীত হয় এবং শিখ ধর্মকে স্বাধীন ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উপর জোর দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন, খালিস্তানি সংগঠন নিষিদ্ধ – কারণগুলো কী
আরএসএস-এর সঙ্গে আর্যসমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক ছিল, যা দেখা গিয়েছিল শিখদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কেও। আরএসএস এবং বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে প্রায়শই শিখ গুরুদের প্রশংসা করতে দেখা গিয়েছে শুধু নয়, আরএএস এঁদের জন্মবার্ষিকীও পালন করে থাকে।
আরএসএস-এর সংজ্ঞায় শিখ ধর্ম
আরএসএস-এর বোঝাপড়া অনুসারে, ভারতে উদ্ভূত যে কোনও ধর্মই হিন্দু রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত। এ বোঝাপড়া নিয়ে সমস্যা রয়েছে অকাল তখতের।
আরএসএস অনুমোদিত রাষ্ট্রীয় শিখ সঙ্গতের প্রেসিডেন্ট জি এস গিল বলেন, "মোহন ভাগবত নতুন কিছু বলেননি বা আপত্তিকর কিছুও বলেননি। আরএসএস-এর মূল ধারণা হল ভারত হিন্দু রাষ্ট্র। কিন্তু আরএসএস প্রধান হিন্দু রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায় তার ব্যাখ্যা করেছেন। সে অর্থ হল, দেশের বিকাশে যারা অংশ নিয়েছে তেমন সব সম্প্রদায়। একই সঙ্গে সমস্ত দেশীয় ধর্মকে এর অংশ বলে বর্ণনা করার মাধ্যমে মোহন ভাগবত হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবনাকে বৃহত্তর করেছেন।"
আরএসএস সম্পর্কে অকাল তখতকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন ডক্টর সুখপ্রীত সিং উডোকে। তিনি আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, "আরএসএস মনে করে, শিখরা মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশীয় আদর্শকে রক্ষা করেছে। আরএসএস জৈন এবং বৌদ্ধদের মতই শিখদেরও হিন্দু রাষ্ট্রের অংশ বলে মনে করে, যা তারা মুসলিম বা খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে মনে করে না। শিখরা আরএসএস-এর এ ধারণার বিরুদ্ধে, তারা মনে করে তাদের ইতিহাস কেবল মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধের ইতিহাস নয়... শিখরা তাদের নিজেদের ধর্মকে স্বাধীন হিসেবে মনে করে এবং এ ধর্মের নিজস্ব পরিচিতি রয়েছে বলে মনে করে।"
গুরু নানক দেব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধর্ম শিক্ষক বলেন, "আরএসএস আর্য সমাজের মত নয়, তারা শিখ গুরুদের শ্রদ্ধা করে। কিন্তু সমস্যা হল রাঞ্জাবে আরএসএস এবং বিজেপির অধিকাংশ নেতাই এসেছেন আর্য সমাজ বা কংগ্রেস থেকে। স্থানীয় নেতারা বোঝেনই না যে শিখ গুরুদের নিয়ে আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি আর্য সমাজের থেকে আলাদা। ফলে শিখদের কেমন ভাবে দেখা উচিত সে নিয়ে আরএসএস-এর মধ্যেই সমস্যা রয়েছে, যার ফলে অকাল তখতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়ছে।"
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: অযোধ্যা মামলায় মোড়- কাকে বলে ওয়াকফ?
গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ
আরএসএস নেতৃত্ব ছাড়াও জন সংঘ এবং বিজেপি নেতৃত্বের নেওয়া কিছু অবস্থানও আরএসএস এবং শিখদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে।
১৯৬০ সালে জলন্ধরে আরএসএস প্রধান গুরু গোলওয়ালকর বলেন, পাঞ্জাবি হল সমস্ত পাঞ্জাবিদের মাতৃভাষা। আরএসএস-এর সংগঠন জনসংঘ ১৯৫৬ সালে আর্য প্রতিনিধি সভার শুরু করা "হিন্দি বাঁচাও আন্দোলনে" যোগ দেয়। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা ১৯৬১ সালের জনগণনায় পাঞ্জাবি হিন্দুদের তাঁদের মাতৃভাষা হিন্দি হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য চাপ দেয়।
১৯৮৪ সালে স্বর্ণ মন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টারে সমর্থন করে বিজেপি। ২০০৯ সালে দল তাদের অবস্থান বদল করে, এবং প্রয়াত অরুণ জেটলি অপারেশন ব্লু স্টারকে ঐতিহাসিক ভুল বলে আখ্যা দেন।
১৯৯৯ সালে আরএসএস প্রধান কে এস সুদর্শন দমদমি টাকশালের সদর দফতর পরিদর্শন করেন। একসময়ে এ দফতরের প্রধান ছিলেন জঙ্গি নেতা জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে। তত দিনে অকালি দল বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে ফেলেছে।
২০০৪ সালের ১৩ জুলাই অকাল তখত আরএসএস এবং রাষ্ট্রীয় শিখ সঙ্গতের কাজকর্ম সম্পর্কে সাবধান হওয়ার ব্যাপারে নির্দেশিকা জারি করে। এই দুই সংগঠনই গুরু গ্রন্থ সাহিব প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, এবং শিখ বিশ্বাসের আরএএস মত বলে অকাল তখত-কে প্রদর্শন করে সাহিত্য প্রকাশ করে।
১৯৯৯ সালে সুদর্শনের আগমনের যিনি মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন, রাষ্ট্রীয় শিখ সঙ্গতের সেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রুলডা সিংকে ২০০৯ সালে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে আরএসএস-এর রাজ্য সহ সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জগদীশ গঙ্গেজার হত্যাকাণ্ডের পিছনে শিখ জঙ্গিদের দায়ী করে পুলিশ। ২০১৭ সালে লুধিয়ানায় খুন হন আরএসএস নেতা রবীন্দর গোসাই। রাষ্ট্রীয় শিখ সঙ্গত বলে. অকাল তখতের নির্দেশিকার কারণে শিখ সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে ভুল ধারণা এই হত্যাকাণ্ডের কারণ হতে পারে।
আরএসএস-এর মুখপাত্র অবতার সিং বলেন, "অকাল তখতের ভুল ধারণা নিয়ে আলোচনা করার ব্যাপারে আরএসএস-এর দরজা সর্বদাই খোলা।"
বৃহত্তর কর্মপদ্ধতি
রাষ্ট্রীয় শিখ সঙ্গত সম্প্রতি এমন কিছু ইস্যু নিয়েছে, যা আগে শোনা যেত শুধু এসজিপিসি-র কাছেই। এর মধ্যে রয়েছে, শিখ বন্দি, সরকারের কালো তালিকায় শিখেরা, অথবা ১৯৮৪ সালের দাঙ্গায় ন্যায়বিচার। আরএসএস কালো তালিকা খতম নিয়ে আন্দোলন এবং ভারতের দূতাবাসগুলিতে গুরু নানকের জন্মবার্ষিকী পালনের মত বিষয়ে প্রচারের দাবি করতে শুরু করেছে। বেশ কিছু বিষয়ে এসজিপিসি-র সমালোচনাও করেছে শিখ সঙ্গত।
ইতিমধ্যে প্রাক্তন শিখ জঙ্গিদের সঙ্গে বোঝাপড়ার রাস্তায় হাঁটছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তাদের একজন জসওয়ন্ত সিং ঠেকেদার কয়েক দশক পর দিল্লি ফিরে এসে বলেছে, "অকালি দল কালোতালিকা খতম করছে না, করছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।"
অকাল তখতের জাঠেদার গিয়ানি হরপ্রীত সিং, যিনি মোহন ভাগবতের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন, তিনি বলেন, "একটা কথা স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া দরকার। আমরা যখন আরএসএস-এর বিরোধিতা করি, তখন আমরা হিন্দুদের বিরোধিতা করি না। আরএসএস হিন্দুত্ব প্রচার করতেই পারে, তাতে আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু শিখ কী, সে নিয়ে বলা ওদের বন্ধ করা উচিত। শিখ কারা সে নিয়ে বলার জন্য শিখদের বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমরা কারা সে কথা বলার জন্য আমাদের কোনও বাইরের লোক দরকার নেই... আমরা আরএসএস-এর হিন্দু রাষ্ট্রের অংশ নই।"
Read the Story in English