গত সপ্তাহে পাঁচকুলার আদালত ২০০৭ সমঝোতা বিস্ফোরণ মামলায় সব অভিযুক্তকে প্রমাণের অভাবে রেহাই দিয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে নাম ছিল প্রাক্তন আরএসএস সদস্য নবকুমার সরকার ওরফে অসীমানন্দের। যেসব মামলায় উগ্রপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে সেসব ঘটনার মূল চক্রী এবং আদর্শগত নেতা হিসেবে নাম উঠে এসেছে এই অসীমানন্দের। যে ছটি মামলায় প্রাক্তন আরএসএস সদস্যদের যোগ রয়েছে বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন, তার দ্বিতীয়টিতে সমস্ত অভিযুক্তরা নিম্ন আদালতে রেহাই পেয়ে গেল। এর আগে এ ধরনের খালাসের ঘটনা ঘটেছে ২০০৭ সালে হায়দরাবাদে মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণ মামলায়। এনআইএ কেনও ক্ষেত্রেই খালাসের বা জামিনের নির্দেশের বিরুদ্ধে আবেদন করেনি। অন্য মামলাগুলির দিকে একবার তাকানো যাক-
আজমীর দরগা মামলা
২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর রাজস্থানের আজমীর দরগা শরিফে এক বোমা বিস্ফোরণে তিনজন মারা যান ও ১৭ জন আহত হন। ২০১১ সাল পর্যন্ত রাজস্থান এটিএস এ মামলার তদন্ত করে, এর পর মামলা হস্তান্তরিত হয় এনআইএ-র কাছে। ২০১০ সালে রাজস্থান এটিএস তিনজনকে গ্রেফতার করে চার্জশিট দেয়। এনআইএ গ্রেফতার করে ৬ জনকে। এরা সকলেই হয় সরাসরি আরএসএসের সঙ্গে অথবা সংঘ পরিবারের কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে থেকে মোট ১৩ জন অভিযুক্তকে চিহ্নিত করে চার্জশিট দাখিল করে।
অভিযুক্তদের খতিয়ান: অসীমানন্দ, দেবেন্দ্র গুপ্তা, চন্দ্রশেখর লেভে, লোকেশ শর্মা, মুকেশ বাসানি, ভারত মোহন লাল রতিশ্বর, সন্দীপ ডাঙ্গে, রামচন্দ্র ওরফে রামজি কালসাংরা, সুনীল জোশী, ভবেশ ভাই প্যাটেল, সুরেশ নায়ার, হর্ষদ সোলাঙ্কি এবং মোহুল ওরফে মফৎ ভাই ওরফে মহেশভাই গোহিল। এদের মধ্যে নায়ার ডাঙ্গে এবং কালসাংরা পলাতক বলে ঘোষিত, জোশী মৃত।
আরও পড়ুন, সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ: কারা অভিযুক্ত, কী ছিল চার্জশিটে
এনআইএ চার্জশিট অনুসারে অভিযুক্তদের এবারে আদর্শগত প্রশিক্ষণ পেয়েছিল অসীমানন্দের কাছ থেকে এবং প্রয়োগসংক্রান্ত নেতৃত্ব পেয়েছিল জোশীর কাছ থেকে। এরা সিদ্ধান্ত নেয় হিন্দু মন্দিরে আক্রমণের বদলা নিতে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বোমা হামলা করা হবে। ২০০৬ সালে গুজরাটের ভালসাডে আয়োজিত এক বৈঠকে এরা হামলা চালানোর জন্য দিল্লির জামা মসজিদ, আজমীর দরগা, সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেন, মালেগাঁও এবং মক্কা মসজিদকে বেছে নেয় বলে অভিযোগ।
চার্জশিট অনুসারে ডাঙ্গে এবং কালসাংরা বিস্ফোরক সংগ্রহ করে এবং দুটি বোমা বানায়, এর মধ্যে একটি বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল। টাইমার হিসেবে ব্যবহারের জন্য সিম কার্ড ও মোবাইল সংগ্রহ করেছিল গুপ্তা এবং লোকেশ শর্মা বিস্ফোরক বহন করেছিল। মোবাইল লুকিয়ে রাখার কাজে যুক্ত ছিল লেভে এবং টাকাপয়সা ও থাকার জায়গা জুগিয়েছিল রতিশ্বর। বাকিরা বোমা বানানো এবং তা ঘটনাস্থলে রাখার ব্যাপারে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছিল বলে অভিযোগ।
চার্জশিট অনুসারে অধিকাংশ অভিযুক্তই মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণে যুক্ত ছিল এবং দু জায়গায় একই ধরনের বোমা ব্যবহৃত হয়েছিল।
মামলার অবস্থা: এই মামলাগুলির মধ্যে এটিরই বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। মামলা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের জুন মাসে। ২০১৭ সালের ৮ মার্চ জয়পুরের বিশেষ আদালত আরএসএস প্রচারক হুপ্তা এবং প্যাটেলকে দোষী সাব্যস্ত করে। এই একটি মামলাতেই বাদী পক্ষ আদালতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে সক্ষম হয়। গুপ্তা ও প্যাটেলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। অসীমানন্দ এ মামলায় খালাস পেয়ে যায়। খালাস পায় হর্ষদ সোলাঙ্কি, লেভে, ভাসানি, লোকেশ, মেহুল এবং রত্নেশ্বরও। এদের সকলকেই বেনিফিট অফ ডাউট দেয় আদালত। এ মামলায় ১৪৯ জনের মধ্যে ২৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য বদল করে। মামলা চলাকালীন এক সাক্ষাৎকারে এনআইএ-র বিশেষ আইনজীবী অশ্বনী শর্মা বলেন, এনআইএ সিবিআইয়ের মত করে সাক্ষীদের সুরক্ষা দিচ্ছে না।
মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণ
১৮ মে ২০০৭। শুক্রবারের প্রার্থনার সময়ে মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় নিহত হন ৯ জন এবং ৫৮ জন আহত হন। তদন্তের সময়ে দুটি না-ফাটা বোমাও উদ্ধার হয়। শুরুর দিকে হায়দরাবাদ পুলিশ এ ঘটনা জেহাদি গোষ্ঠীর কাজ বলে মনে করে এবং বেশ কয়েকজন মুসলিমকে সন্দেহের তালিকায় রাখে। পরে এ মামলা সিবিআইয়ের কাছে তুলে দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে নামপল্লি আদালতে দুজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে সিবিআই। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে মামলা হস্তান্তরিত হয় এনআইএ-র কাছে। ১০ জনকে অভিযুক্ত করে তিনটি চার্জশিট দাখিল করে তারা। সিবিআই যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিল, তাদের নামও এই চার্জশিটে ছিল।
অভিযুক্তদের খতিয়ান: অসীমানন্দ, দেবেন্দ্র গুপ্তা, লোকেশ শর্মা, রতিশ্বর, ডাঙ্গে, কালসাংরা, সুনীল জোশী, রাজেন্দর চৌধরি এবং অমিত চৌহান ছিল অভিযুক্ত। এনআইএ-র কথা মত, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে আয়োজিত বেশ কয়েকটি বৈঠকে তারা হিন্দু মন্দিরে আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে ষড়যন্ত্র করে। এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৪ সালে উজ্জ্বয়িনীর কুম্ভমেলায়, ২০০৫-০৬ সালে শবরী ধামে এবং বালসাড়ের টাকুর গড়ে। অভিযোগ, অসীমানন্দের শ্লোগান ছিল বম্ব কা জবাব বম্ব সে দেনা হ্যায়।
ভালসাড়ের বৈঠকে জোশী জানায় যে সে গুপ্তার সাহায্যে সিম কার্ড এবং মোবাইল সংগ্রহ করেছে যেগুলি বিস্ফোরকের টাইমার হিসেবে কাজে লাগানো যাবে। এমনকি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও রাখা যাবে ওই মোবাইলগুলির মাধ্যমে। ২০০৬ সালের শেষে একটি পরিবহণ দফতর থেকে কিছু শেল সংগ্রহ করে কালসাংরা। ইন্দোরের মানবতা নগরে বোমা তৈরি হয় বলে অভিযোগ, যেগুলিতে মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
মামলার অবস্থা: ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নামাপল্লির এনআইএ বিশেষ আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে এবং ৭২ জন প্রার্থীকে সমন পাঠায়। ২০১৬ সালে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৮ সালের ১৬ এপ্রিল সব অভিযুক্তকে খালাস করে দেয় আদালত। এই একই প্রমাণাদির ভিত্তিতে কিন্তু গুপ্তাকে আজমীর মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। আইইডি-তে ব্যবহৃত সিম কার্ড সে-ই কিনেছিল বলে অভিযোগ। দুটি বিস্ফোরণে একই সেটের সিম কার্ড ব্যবহৃত হয়েছিল।
যে ২৬৬ জনের নাম সাক্ষ্যতালিকায় রাখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৬৬ জন বাদী মামলাকে সমর্থন করেনি। এদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুরোহিতের নামও ছিল। ২০০৮ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে নাম ছিল পুরোহিতের। অন্য মামলাগুলির ষড়যন্ত্রেের অংশীদার হিসেবেও পুরোহিতের নাম উঠে এসেছে।
অন্য তিনটি মামলা
অন্য যে তিনটি মামলায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নাম উঠে এসেছে, তার মধ্য মোডাসা বিস্ফোরণ মামলা এনআইএ ২০১৫ সালের মে মাসে বন্ধ করে দিয়েছে। মালেগাঁও বিস্ফোরণের দুটি মামলা এখনও শুরু হয়নি। ২০০৬ এবং ২০০৮ মালেগাঁওয়েক দুটি বিস্ফোরণ মামলাতেই মহারাষ্ট্র এটিএস, সিবিআই এবং এনআইএ বেশ কয়েকজনের নামে চার্জশিট দাখিল করে। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিল সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং, লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুরোহিত এবং অসীমানন্দের।
২০০৮ সালের বিস্ফোরণ মামলায় সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে এনআইএ সব অভিযোগমুক্ত করে দেয়। এ ঘটনাকে বেশ বিতর্কের সূচনা করেছিল। এর কয়েক মাস আগেই বিশেষ সরকারি আইনজীবী রোহিণী সালিয়ান ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন এ মামলায় এনআইএ তাঁকে ধীরে চলার পরামর্শ দিয়েছিল। তবে আদালত সাধ্বী সম্পর্কে এনআইএ-র বক্তব্যকে নস্যাৎ করে দেয়। ইউএপিএ-র আওতায় অভিযুক্ত করা হয় তাকে।