বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে ৫ কোটি মানুষ কোনও না কোনও ধরনের ডিমেনশিয়ায় ভোগেন। যার মধ্যে আলঝেইমার অন্যতম। সমীক্ষা বলছে, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ উন্নয়নশীল দেশে বাস করেন। বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গেই অনুমান করা হয় যে ২০৫০ সালের মধ্যে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩৯ লক্ষ বেড়ে যাবে। চিন, ভারত, লাতিন আমেরিকা এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার লোকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। গবেষকরা কয়েক দশক ধরে আলঝেইমার রোগের চিকিৎসা খুঁজে বের করতে গবেষণা করছেন। কিন্তু, বলতে গেলে এখনও পর্যন্ত তাঁদের সাফল্য সীমিত। তবে, লেকনম্যাব বা লেকানেমাব (Lecanemab) নামে একটি ওষুধ আবিষ্কারের পর থেকে নতুন আশা দেখা দিয়েছে। এই ওষুধ ২০২৩ সালে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। আলঝেইমার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে, এই ওষুধের ব্যবহার তাকে বাড়তে বাধা দেয়।
মস্তিষ্কে জটিল প্রক্রিয়া
আলঝেইমারের বিরুদ্ধে ওষুধ তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং। কারণ, গবেষকরা এখনও পুরোপুরি জানতে পারেননি যে এই রোগ ধরা পড়লে মস্তিষ্কে কী প্রতিক্রিয়া ঘটে। সবচেয়ে ধামাচাপা থাকা প্রশ্নগুলোর একটি হল, কেন মস্তিষ্কের কোষগুলি মারা যায়? গবেষকরা জানেন যে অ্যামাইলয়েড এবং টাউ প্রোটিন মস্তিষ্কে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি কীভাবে অ্যামাইলয়েড এবং টাউ প্রোটিন মস্তিষ্কে একসঙ্গে কাজ করে বা কোষের মৃত্যু ডেকে আনে। তবে, বেলজিয়াম এবং ব্রিটেনের গবেষকদের দাবি, তাঁরা এখন জলের মত বলে দিতে পারবেন, কীভাবে ব্যাপারটা ঘটছে। যদিও সেটা স্রেফ দাবি। গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সামনে বেলজিয়াম এবং ব্রিটেনের গবেষকরা তাঁদের এই দাবির সত্যতা এখনও প্রমাণ করতে পারেননি।
কোষের মৃত্যুরহস্য
সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুসারে গবেষকরা বলেছেন যে এই অস্বাভাবিক প্রোটিন, অ্যামাইলয়েড এবং টাউ এবং যাকে বলা হয় নেক্রোপ্টোসিস বা কোষের মৃত্যু, তার মধ্যে সরাসরি সংযোগ রয়েছে। কোষের মৃত্যু সাধারণত সংক্রমণ বা জ্বালাপোড়ার জেরে হয়। আর, শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের শরীরকে অবাঞ্ছিত কোষ থেকে মুক্তি দেয়। দেহে, নতুন সুস্থ কোষ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। যখন শরীরে পুষ্টির সরবরাহ কমে যায়, প্লাজমা ঝিল্লি ধ্বংস হয়, কোষগুলো ফুলে ওঠে আর মারা যায়।
গবেষকদের বক্তব্য
গবেষকদের দাবি, অ্যামাইলয়েড প্রোটিন মস্তিষ্কের নিউরনে প্রবেশ করলে অ্যালঝাইমার রোগীদের কোষগুলোও ফুটে ওঠে। এই কোষের অভ্যন্তরে রসায়নের পরিবর্তন হয়। অ্যামাইলয়েড জমাট বাঁধে এবং ফাইবার-সদৃশ টাউ প্রোটিনও নিজস্ব বান্ডিল তৈরি করে। যা পরিচিত হয় টাউ ট্যাঙ্গেল নামে। যখন এই দুটি জিনিস ঘটে তখন মস্তিষ্কের কোষগুলি এমইজি৩ নামে এক অণু তৈরি করে। গবেষকরা এমইজি৩ আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, যখন মস্তিষ্কের কোষগুলি বেঁচে থাকে, তখন তারা এই এমইজি৩-কে আটকাতে পারে। তার অর্থ, একে আটকানো সম্ভব। সেটা কীভাবে সম্ভব, তা দেখার জন্য গবেষকরা জিনগতভাবে পরিবর্তিত ইঁদুরের মস্তিষ্কে মানব মস্তিষ্কের কোষ প্রতিস্থাপন করেছিলেন। যা প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইলয়েড তৈরি করেছিল। এই গবেষকদের অন্যতম, ব্রিটেনের ডিমেনশিয়া গবেষণা ইনস্টিটিউটের বার্ট ডি স্ট্রোপার। তিনি পরীক্ষার পরে বলেছেন, তিন থেকে চার দশক ধরে জল্পনা-কল্পনার পর প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা আলঝেইমার রোগীদের কোষের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ খুঁজে পেয়েছেন।
আরও পড়ুন- ভিসায় গন্ডগোল! কেন অরুণাচলের খেলোয়াড়দের ভিসা দিল না চিন?
নতুন ওষুধের আশা
বেলজিয়ামের কেইউ লিউভেন এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের ডিমেনশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলেছেন, তাঁরা আশা করছেন যে গবেষণার ফলাফলগুলো আলঝেইমার রোগীদের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। গবেষকদের আশা, লেকানেমাব ওষুধ সরাসরি প্রোটিন অ্যামাইলয়েডকে নিশানা করে। যদি, অ্যামাইলয়েডকে রোখা যায়, তবে এমইজি৩ অণুকেও রোখা সম্ভব হবে। আর, তাহলেই মস্তিষ্কে কোষের মৃত্যু পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে। রোখা যাবে আলঝেইমার্স।