রাষ্ট্রদ্রোহ আইন। নতুন করে শিরোনামে তা যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এস জি ভোমবাটকারে এই আইনটির সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা ঠুকেছেন সুপ্রিম কোর্টে। মহাত্মা গান্ধী, বাল গঙ্গাধর তিলকের মুখে সেলোটেপ আটকাতে, হাতে-পায়ে শিকল পরাতে যে আইন তৈরি করেছিল ব্রিটিশরা, তা এখনও রক্ত ঝরাচ্ছে। এই মামলায় আবার সেই আইন কাঠগড়ায় উঠল। প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা মামলাটি শুনবেন। রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বা ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ (এ)-র ক্ষমতায় কত কি না হয়েছে। তিল থেকে কত তাল হয়েছে। নয় থেকে ছয়ও কত হয়েছে-- তার কোনও ইয়ত্তা নেই। এটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে, এমনই দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ ভোমবাটকারে।
এর আগেও কাঠগড়ায় আইন
বহুবার রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বারবার আইনের ফাঁক গলে সুরক্ষিত ভাবেই বেরিয়ে এসেছে এটি। আইনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক মামলাটি হল ১৯৬২-র। সুপ্রিম কোর্টে সম্মুখসমরে কেদার নাথ বনাম কেন্দ্রীয় সরকার। কেদারবাবু জিততে পারেননি, কিন্তু এই আইনটি ভুল ব্যবহারে লাগাম টানতে বলছিল সুপ্রিম কোর্ট। সন্ত্রাসে উস্কানি বা সন্ত্রাসের ডাক না দিলে রাষ্ট্রদ্রোহের তকমা দেওয়া যাবে না। বলেছিল আদালত। কিন্তু চোর না শোনে ধর্মের কথা। হাতে অস্ত্র থাকলে তার অপব্যবহার আটকানো সহজ নয়। চেতনার ডাক শুনলে রাষ্ট্রের কাঠামো রসাতলে যাবে, এমনও বলেন অনেকে। ইশারায় ক্ষমতা ধরে রাখার খেলা চলে। উত্থান-পতনের স্রোত চলতে থাকে পথের কাঁটাগুলি সরিয়ে। তাদের এক ছোবলে ছবি করে দিতে দিতে। তাই প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে ওঠে দেশদ্রোহ আইন। যার ইংরেজি নাম সিডিশন ল।
কবে আবির্ভাব?
১৮৭০ সালে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে গর্জন রুখতে এই আইনটি তৈরি তৈরি করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত যাতে আলগা না হয়ে যায়, তার জন্যই এর উৎপত্তি। তবে ভারতীয় দণ্ডবিধির যে মূল খসড়া তৈরি হয়েছিল ১৮৬০ সালে, তাতে ১২৪ (এ) ধারাটি ছিল না। কী বলছে এই ধারা? লিখিত ভাবে কিংবা বক্তব্য বা চিহ্নের মাধ্যমে অথবা দৃশ্যমান কোনও উপস্থাপনার সাহায্যে অথবা অন্য কোনও উপায়ে যদি ঘৃণা ছড়ানো হয়, কিংবা উস্কানি দেওয়া হয়, তা হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা পেতে হবে। সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে। অথবা আরও তিন বছর কারাদণ্ড হতে পারে।
আগেই বলেছি, স্বাধীনতার পর এই আইনের ব্যবহার থেমে থাকেনি। নানা সময় নানা জনের বিরুদ্ধে এটি ব্যবহৃত হয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে অরুন্ধতী রায় এই আইনে কাঠগড়ায় ওঠেন। পাতিদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক প্যাটেলের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে এই আইনে মামলা হয়। পরিবেশ কর্মী দিশা দেবী, জেএনইউ-র বিদ্রোহী মুখ কানাইয়া কুমার, ওমর খালিদ, সাংবাদিক বিনোদ দুয়া, সিদ্দিক কাপ্পানদের বিরুদ্ধেও সাম্প্রতিক কালে এই আইনে মামলা হয়েছে। আইন থাকলে তালিকা আরও দীর্ঘ হবে বৈকী!
আরও পড়ুন ড্রাগনভূমিতে একশো বছর
কবে এই আইন প্রথম গান্ধী-তিলকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হল?
লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস বা বা এলওসি-র ব্লগ বলছে, এই আইন প্রথম ব্যবহার করা হয় বঙ্গবাসী সংবাদপত্রের সম্পাদক যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তিলক ও গান্ধির বিরুদ্ধে মামলায় আইনটিকে ব্যবহার করা হয়েছে বার বার। জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, বিনায়ক দামোদর সাভারকরদের বিরুদ্ধেও এতে মামলা হয়েছিল।
২৯২২ সালে বোম্বাইয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ফাঁসে পড়েন। গান্ধীজিকে ছ'বছরের জন্য জেলে পাঠায় সরকার। যদিও শারীরিক কারণে দু'বছর পর মহাত্মা গান্ধী মুক্তি পান। গান্ধীর আগে বাল গঙ্গাধর তিলক দেশদ্রোহ আইনে তিন বার অভিযুক্ত হন (মানে হ্যাটট্রিক করেন)। দু'বার জেলযাত্রা হয় তাঁর। ১৮৯৭ সালে তাঁর সাপ্তাহিক কাগজ কেশরীতে গঙ্গাধরের একটি প্রবন্ধ নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়। খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ব্রিটিশ সরকার তিলককে তাড়া করে। তিলকের ১২ মাসের কারাবাস হয়। এর পর ১৯০৮ সালে এই আইনে ফের তিলককে বেঁধে ফেলে ব্রিটিশ সরকার। তিলকের হয়ে মামলা লড়েন মহম্মদ আলি জিন্না। কিন্তু জামিনের আবেদন খারিজ হয়। বাল গঙ্গাধর জেলে যান ছ'বছরের জন্য। দ্বিতীয় বারও লেখালেখির জন্য তিলকের এই জেল যাত্রা।
আরও পড়ুন ব্র্যান্ড মোদী বাঁচাতেই কি খোলনলচে বদল মন্ত্রিসভার
এক বার বিদায় দে মা…
১৯০৮ সালের ১১ অগস্ট। মুজফফরপুর ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসি হল ক্ষুদিরাম বসুর। মাত্র ১৮ বছর বয়সে। প্রফুল্ল চাকির সঙ্গে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন ক্ষুদিরাম।
ঘটনাটা ভাল করে বলি...
ঘটনাস্থল: বিহারের মুজাফফরপুরে ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে। সময়: রাত সাড়ে আটটা। পরিকল্পনা মতো হাজির বিপ্লবীরা। ক্লাব থেকে গাড়ি করে ম্যাজিস্ট্রেট বেরোলেই গাড়ি লক্ষ করে বোমা ছোড়ার পরিকল্পনা। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। ব্রিটিশ বিচারক সওয়ার ভেবে বোমা ছোড়া হল গাড়িতে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড ছিলেন না তাতে। ছিলেন মিসেস কেনেডি ও তাঁর মেয়ে। তাঁদের মৃত্যু হল। এর পর প্রফুল্ল চাকি গ্রেফতারের আগে আত্মহত্যা করেন। গ্রেফতার ক্ষুদিরাম, তাঁর ফাঁসি হয়ে গেল। বালগঙ্গাধর তিলক কেশরীতে দুই তরুণ বিপ্লবীর পক্ষে লিখে ইংরেজের কোপে পড়েছিলেন।
কী লিখেছিলেন গঙ্গাধর?
'এই ধরনের ঘটনা বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর এতে ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করাও যাবে না। কিন্তু যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলে শাসক, তা হলে তাদের মনে রাখতে হবে, মানবিকতারও সহ্যের একটা সীমা আছে।'
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন