প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মঙ্গলবার স্থানীয় স্তরে উৎপাদন এবং স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ভারতের এবার স্থানীয়ের জন্য মুখর (ভোকাল ফর লোকাল) হতে হবে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ করবে য়াতে আন্তর্জাতিক জোগান শৃঙ্খলে ভারতীয় শিল্প ভূমিকা রাখতে পারে। ভারতের শিল্প বর্তমানে কতটা স্বনির্ভর এবং কত দ্রুত তারা উন্নতি করতে পারবে!
এই মুহূর্তে কোন ক্ষেত্র আমদানির উপর ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল এবং এখনই দেশিয় স্তরে উৎপাদন বাড়াতে পারবে না?
ভারতের আমদানি ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল স্মার্টফোন এবং কম্পিউটারের মত ইলেকট্রনিক দ্রব্য। ইলেকট্রনিক শিল্পে ভারতের অতিরিক্ত ভূমিকা হল মূলত অ্যাসেম্বল করা। এগুলি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড বা পিসিবিও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মোবাইল হ্যান্ডসেট শিল্পের ৮০ শতাংশ উপাদান চিনের মত দেশ থেকে আমদানি করা হয় বলে জানিয়েছে কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ।
আরও পড়ুন, জিডিপির কত শতাংশ- একটু হিসেব নিকেশ
দেশের মেডিক্যাল ডিভাইসের ৬০ শতাংশের বেশি আমদানি করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া দেশের সৌর শক্তি শিল্পে যেসব সেল ও মডিউল ব্যবহার করা হয় সেগুলিও মূলত আমদানি করা হয়।
কোন কোন ক্ষেত্র তাদের তৈরি উৎপাদনের জন্য আংশিকভাবে আমদানির উপর নির্ভরশীল?
ভারতের ওষুধ শিল্প তৈরি উৎপাদনের জন্য সক্ষম, এবং বেশ কিছু প্রয়োজনীয় উপাদান তারা তৈরিও করে। তবে অ্যান্টিবায়োটিক ও ভিটামিনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তাদের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়, যা এখনও ভারতে বানানো হয় না। দেশ বর্তমানে এই প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি তৈরি করার ব্যাপারে দেশিয় সংস্থাগুলিকে উৎসাহ দিচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে এখনও কয়েক বছর সময় লাগবে।
সিআইআই জানিয়েছে, ভারত ২০১৯ সালে ২৪৯ বিলিয়ন মূল্যের প্রয়োজনীয় উপাদান আমদানি করেছে, যা ভারতের আভ্যন্তরীণ বাজারের ৪০ শতাংশ।
ভেন্টিলেটরের মত মেডিক্যাল ডিভাইসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সোলেনয়েড ভালভ ও প্রেশার সেন্সরের ক্ষেত্রেও আমদানির উপর নির্ভর করতে হয়। কিছু গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা বিভিন্ন উপাদানের জন্য আমদানির উপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে দেশের বিদ্যুৎচালিত গাড়ি শিল্প অনেকাংশেই ক্যাথোড ও ব্যাটারি সেল তৈরির জন্য চিন থেকে আমদানি করা রাসায়নিকের উপর নির্ভর করে বলে জানিয়েছে সিআইআই।
আরও পড়ুন, আরোগ্য সেতু অ্যাপের তথ্য কাদের কাছে যেতে পারে, সংশয় ও উদ্বেগ
ভারতের স্থানীয় রং তৈরির ইউনিটগুলিও অনেকাংশেই কাঁচা মালের জন্য আমদানির উপর নির্ভর করে। উহানে অতিমারী জনিত লকডাাউনের ফলে ভারতের এই শিল্পের প্রায় ২০ শতাংশের উৎপাদন কাঁচা মালের অভাবে মার খেয়েছে।
এমন কোনও ক্ষেত্র কি রয়েছে যেখানে আমদানির উপর নির্ভরশীলতা ন্যূনতম বা এখনই এখানে উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম?
জেএনইউয়ের অধ্যাপক তথা বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ ধরের মতে, বস্ত্র উৎপাদনের অন্যতম উপাদান সুতোর মত ক্ষেত্রে ভারত নির্ভরশীল নয়। তিনি বলেন, “যদিও স্থানীয় শিল্পমহল বলে আসছে যে চিন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তা সত্ত্বেও যদি গোটা পৃথিবীর দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে বস্ত্রশিল্পে ভারতের শেয়ার ক্রমবর্ধমান।”
অগ্রণী ও জটিল ধরনের মেডিক্যাল ডিভাইসে প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রয়োজন হলেও দেশ হট ওয়াটার বটল, মার্কারি থার্মোমিটার, হাইপোডারমিক নিডল, হুইলচেয়ার, রোগির নজরদারি ডিসপ্লে ইউনিটের মত ক্ষেত্রে ভারত পারঙ্গম বলে জানিয়েছেন কিছু শিল্প আধিকারিকরা। অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল ডিভাইসের পোরাম কোঅর্ডিনেটর রাজীব নাথ বলেছেন, অনেক উপাদানই আগে ভারতে তৈরি হত, কিন্তু এখন উৎপাদনকারীরা আমদানি করা পণ্য বাজারে বিক্রির ব্যাপারে বেশি সচেষ্ট।
আমদানি নির্ভর শিল্পের উৎপাদনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে সমস্যা কী?
ভারত সেমিকন্ডাক্টর, ডিসপ্লে এবং আরও কিছু অতি পুঁজিনিবিড় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি আমদানি করে যা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যা হল এর জন্য বড়, স্থিতিশীল পরিষ্কার জল ও বিদ্যুতের প্রয়োজন। এরকম ক্ষেত্রে নীতির দিক থেকেও নিশ্চয়তা প্রয়োজন কারণ এ ধরনের ক্ষেত্রে খুবই বেশি মাত্রায় বিনিয়োগ দরকার। তবে কিছু ক্ষেত্রে যদি কিছু নীতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে ভারতীয় সংস্থা অপেক্ষাকৃত কম উন্নত উপাদান উৎপাদন করতে পারবে।
ভারতে বিদ্যুতের মত বিষয়ের খরচ এবং রসদ ও সরবরাহ খরচ চিনের সংস্থাগুলির তুলনায় অনেকটাই বেশি। ডেকি ইলেকট্রনিক্সের এমডি বিনোদ শর্মা বলেছেন, সাংহাই থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের এক শহর থেকে মুম্বইয়ে কেবল আনার খরচ কিলো প্রতি ৪ টাকা পড়ে, আর মুম্বই থেকে নয়ডার কারখানায় ওই কেবল নিয়ে যাওয়ার খরচ পড়ে কিলো প্রতি ১৪ টাকা। ওষুধের ক্ষেত্রেও এমনটাই বাস্তব বলে দাবি করেছেন ফার্মা আধিকারিকরা। তাঁদের দাবি চিন যখন উৎপাদনে পরিকাঠামো ও রসদ ও সরবরাহের ক্ষেত্রে সাহায্য পেয়ে শস্তায় মাল বিক্রি করতে লাগল তখন ভারত প্রতিযোগিতা থেকে হারিয়ে গেল।
স্থানীয় স্তরে উৎপাদন বাড়াতে গেলে কী ধরনের নীতি নেওয়া উচিত?
ভারতে উৎপাদন যে সব কারণে পিছিয়ে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল অনড় শ্রম আইন, জমির অভাব ও তার উচ্চমূল্য এবং বিদ্যুতের ব্যাপক দাম। উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ তাদের শ্রম আইনে কিছু ছাড় দিয়েছে এবং কর্নাটকও তা দিতে চলেছে।
জেএনইউ অধ্যাপক ধরের কথায়, “প্রথমে শিল্পকে সক্ষম করে তুলতে হবে। তার জন্য এমন কিছু নীতি গ্রহণ করতে হবে যাতে এই শিল্পগুলি সত্যিই বেড়ে ওঠে। একটা শিল্প নীতি প্রয়োজন, একটা নতুন নীতি প্রয়োজন এবং তারপর দেখতে হবে তাদের পরিকাঠামো আরও সক্ষম করে তোলার জন্য এই শিল্পগুলির কী প্রয়োজন।”