আত্মসম্মান। তার বোধ। আছে আপনার ? না না, রেগে যাবেন না, জানি নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আত্মসম্মান বোধ বড় কম পড়িয়াছে এ দেশে। হ্রাসমান এই পৃথিবীতেও। তাই তো? এবার নিশ্চয়ই হ্যাঁ-হ্যাঁ করছেন। কেন করছেন, জানি, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের কথা চিন্তা করেই তো! একদম ঠিক বলেছি তো নাকি! আহ, শুনে ভারি আরাম পেলেন দেখছি। একেবারে আপনার মনের কথা। আত্মসম্মানের পারদ তলানিতে বলেই না এ দল ছেড়ে ও দল, আবার ও দল ছেড়ে এ দলে যেতে পারছেন রাজনীতির বহু কেষ্টবিষ্টু লাইন লাগিয়ে। আত্মসম্মানটির আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হচ্ছে এর ফলে।
এখানে মহামতি সমর সেনকে উদ্ধৃত করার ইচ্ছা জাগছে। বাবুবৃত্তান্ত বলে একটি দুরন্ত বই আছে তাঁর, অনেকেই পড়েছেন। সেখানে দীনেশচন্দ্র সেন, মানে তাঁর ঠাকুর্দার সঙ্গে সমর সেনের একটি সরস কথাবার্তা এখানে বলা যেতে পারে-- 'বিয়েতে ভালো করলে বিলেত পাঠাবার প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দেওয়াতে (ঠাকুর্দা) বললেন যে অর্ধেক খরচ দেবেন, বাকিটা বিয়ে করে জোগাড় করতে। বললাম-- ''দাদু, পুরুষাঙ্গ বাঁধা দিয়ে বিলেত যাব না।'' উত্তরে অট্টহাস্য হেসেছিলেন।' পুরুষাঙ্গ বাঁধা দেওয়া বলতে সমর সেন বুঝিয়েছেন ওই আত্মসম্মান খোয়ানোকে। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কথা না বললে চলে না, ঝোলে লাউ অম্বলে যিনি কদু, আত্মসম্মানের কথা কত লেখায় যে বলেছেন কত কায়দায়, কখনও ফার্স্ট বোলিং, কখনও মিডিয়াম পেস, কখনও সিমার, কখনও গুগলি, কবজির নানা মোচড়ে এসেছে এই আত্মসম্মান। 'তোমার শঙ্খ ধুলায় পড়ে কেমন করে সইব'… এই 'শঙ্খ' হল রবিঠাকুরের আত্মসম্মান। মর্যাদা। যা হোক এটি নিয়ে এই সব কথা ফাঁদার একটা কারণ রয়েছে, সেটি হল, এ ব্যাপারে সম্প্রতি একটি ওজনদার গবেষণা হয়েছে। করেছে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিস এবং ইউনিভার্সিটি অফ বার্ন (Bern)।
কী বলছে গবেষণা?
এই সময়ে আত্মসম্মান বোধ হ্রাসমান হলেও, এই বোধটি সমাজকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে রাখে, নানা খুঁটিনাটি তুলে ধরে বলছে ওই গবেষণার ফল। হাই সেলফ এস্টিম সমাজের নানা ক্ষেত্রে পজিটিভ তরঙ্গ ছড়িয়ে দেয়, বলেছেন গবেষকরা।
সমাজের নানা স্তরে গবেষকরা প্রখর আত্মসম্মান বোধের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তাও জানিয়ে দিয়েছেন ইঞ্চি মেপে। বলেছেন, আত্মসম্মান বোধ যাঁদের মধ্যে প্রখর, তাঁরা চেতনায় অনেক এগিয়ে।
যদি বাবামায়ের আত্মসম্মানের প্রখরতা থাকে, তা হলে সন্তানের মধ্যেও তা চারিত হয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে, আত্মসম্মান বোধের আলোয় আলোকিত বাচ্চাদের কেরিয়ার ভাল হয়ে থাকে। স্কুলে তারা পারফরম্যান্সের বিচারে এগিয়ে থাকে। আত্মসম্মানী জনেরা কাজের জায়গাতেও বেশি সাফল্য পান। এই বোধ মানসিক স্বাস্থ্য, শরীরের যন্ত্রগুলোকেও ভাল রাখে বলেই দেখাচ্ছে গবেষণা। সবচেয়ে বড় কথা, অপরাধ প্রবণতা, দেখা যাচ্ছে, সেই সব মানুষের কম, অনেক বেশি সমাজমনস্ক হয়ে থাকেন তাঁরা। ছোটবেলা থেকে যাঁদের সেলফ এস্টিম উঁচুতে, তাঁরা তা এগিয়ে নিয়ে চলেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাকি জীবন ধরে। গোটা সমাজে তাঁদের গুরুত্ব হয়ে ওঠে অপরিসীম।
ইউনিভার্সিটি অফ বার্নের মনস্তত্ত্বের প্রোফেসর রিচার্ড রবিন্স এই গবেষণা সম্পর্কে লিখেছেন জার্নাল আমেরিকান সাইকোলজিতে। এটি আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল। রবিন্স বলেছেন, গবেষণায় সামনে এসেছে, সেলফ এস্টিমের গুরুত্ব রয়েছে বলে বেশির ভাগ মানুষই মনে করছেন এখনও। রবিন্স বলছেন, বিন্দুতে বিন্দুতে সিন্ধু হয়। যদি এক বছরে এই কোনও আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন মানুষের দিকে তাকানো যায়, তা হলে এর সামান্য প্রভাব চোখে পড়তে পারে। কিন্তু তিরিশ বছরের সময়কালে যদি সেই মানুষটিকে বিশ্লেষণ করা যায়, তা হলে বোঝা যায় প্রখর আত্মসম্মানের প্রভাব তাঁর জীবনে কতটা। যাকে ক্রমসঞ্চিত সুফল বলা যেতে পারে। ইংরেজিতে বলা হয়, কিউমুলেটিভ বেনিফিট।
নার্সিসিজম এবং প্রখর আত্মসম্মান বোধ
রবিন্স দীর্ঘ সময় ঘরে এই আত্মসম্মান বোধ নিয়ে চর্চা করছেন। অনেক সময়তেই তাঁকে শুনতে হয়েছে, প্রখর আত্মসম্মান বোধ মারাত্মক। যা আসলে ভুল ভাবনা একটি। রবিন্সের বিচারে আত্মসম্মান বোধ এবং নার্সিসিজমের মধ্যে ফারাকটা বুঝে নিলেই এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। সেলফ এস্টিম বলতে বোঝানো হচ্ছে, নিজের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা, আত্মমর্যাদা বোধ। কিন্তু নার্সিসিজমের জন্ম হচ্ছে নিজেকে বড় করে দেখার মধ্য থেকে। নিজেকে মহানুভব মনে করা। আত্মকেন্দ্রিকতা।
গবেষণা বলছে প্রখর আত্মসম্মান বোধ এবং নার্সিসিজম এক অপরের উল্টো পথে চলে। প্রভাবও দুই বিপরীত মেরুতে বাড়ে। আত্মসম্মানটিকে তাই বাঁচিয়ে রাখুন, আগলে রাখুন। হয়তো তাৎক্ষণিক ভাবে চলার পথে, সে জন্য কিছু কম পেতে পারেন। কিন্তু আদতে আপনিই লাভবান হবেন, লাভ হবে দীর্ঘকালের বিচারে। পরবর্তী প্রজন্মের নিরিখেও আপনি ডিভিডেন্ট পাবেন। আশপাশটাও সুন্দর, প্রাণ ধারণের পক্ষে উপযুক্ত থাকবে।