অঙ্ক! বিষয়টির নাম শুনলেই হৃদযন্ত্র কেঁপে ওঠে অনেক পড়ুয়ার। কিন্তু সেই অঙ্ককেই যিনি 'বেহিসেবি' করে দিয়েছিলেন, তিনিই শকুন্তলা দেবী। অ্যামাজন প্রাইমে সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবির দৌলতে তাঁর নাম এখন সকলেই জানে। কিন্তু বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলে তিনি এখনও 'রহস্যময়ী নারী'। প্রথাগত কোনও অঙ্ক শিক্ষা নেই, কগনিটিভ টেস্ট বলতে যা বোঝায় দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা শকুন্তলা দেবীর এসবের বালাই ছিল না। তবে যা ছিল তা এমনই অঙ্ক, যার সমাধান শকুন্তলা দেবী ছাড়া কোনও বিজ্ঞানীই কষে উঠতে পারেননি। শকুন্তলা দেবীর মাথায় কি তবে বিশেষ কোনও যন্ত্র ছিল?
১৯২৯ সালে জন্ম শকুন্তলার। মা-বাবা দু'জনেই কাজ করতেন একটি সার্কাসের দলে। তিন বছর বয়স থেকেই সার্কাসের দলে ভিড়েছিলেন তিনিও। কার্ডের একটি ম্যাজিক দেখাতে গিয়েই আবিষ্কার হয় তাঁর এই বিস্ময়কর ক্ষমতা। ওই বয়সেই কিউবের হিসেব ক্যালকুলেটরের থেকেও কম সময়ে কষে ফেলতেন শকুন্তলা দেবী। সার্কাসে তিনিই তখন জনপ্রিয় মুখ। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলিতে খেলা দেখিয়েই পয়সা রোজগার চলত প্রথম জীবনে।
কী কী ক্ষমতা ছিল তাঁর?
ঘনমূল (কিউব রুট): এই অঙ্ক ছোটোবেলায় কমবেশি সকলেই করেছি। যেমন ৮ এর (ঘনমূল) ২। অঙ্কের ভাষায় ভেঙে দেখালে, ২x২x২=৮। কিংবা উল্টোটা অর্থাৎ, ৩√৮ এর উত্তর হবে=২। ৫ এর ক্ষেত্রে তা ১২৫ কিংবা ৩√১২৫ এর উত্তর ৫। কিন্তু এত গেল সহজ হিসেব। এবার যদি বলা হয়, ৯৫,৪৪৩,৯৯৩ এই সংখ্যার ঘনমূল কী হবে? সংখ্যা দেখেই হোঁচট খেলেন তো? ক্যালকুলেটরে লিখে উত্তর পেতেও ১০ সেকেন্ড লাগবে। তবে শকুন্তলা দেবী কিন্তু ২ সেকেন্ডে বলে দিয়েছিলেন উত্তর হবে, ৪৫৭। ১৯৮৮ সালে তাঁর মস্তিষ্কের এই ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে গিয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া-বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ববিদ আর্থার জেনসন। ৫ সেকেন্ডে শকুন্তলা দেবী বলে দিয়েছিলেন ৫৮৯-এর ঘন (কিউব) হবে ২০৪,৩৩৬,৪৬৯ এবং ২,৩৭৩,৯২৭,৭০৪-এর ঘনমূল (কিউব রুট) হবে ১৩৩৪।
এতক্ষণে হোঁচট খেয়ে হেঁচকি তুলেছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য অবাক হওয়া কিন্তু এখনও বাকি। ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতা না কি কেবল চর্চা তা তর্কাতীত। ১৯৩৩ সাল থেকে একইভাবে অঙ্কের জটিল হিসেব সামলেছেন শকুন্তলা দেবী। কেবল কিউব রুট নয় 'হাইয়ার রুটস' অর্থাৎ কোনও সংখ্যার সেভেনথ রুট কী হতে পারে তাও অসীম দক্ষতায় বলেছেন তিনি। ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর দিয়েছেন ৪৫৫,৭৬২,৫৩১,৮৩৬,৫৬২,৬৯৫,৯৩০,৬৬৬,০৩২,৭৩৪,৩৭৫ এই সংখ্যার সেভেনথ রুট ৪৬,২৯৫। শকুন্তলা দেবী ঠিক উত্তর দিয়েছেন কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে ৪৬,২৯৫ এই সংখ্যাটিকে ৭ বার গুণ করে দেখে নিতে পারেন। তবে শুধু মাথায় রাখতে হবে ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর দিয়েছিলেন শকুন্তলা!
এত গেল অঙ্কের একদিককার কথা। লম্বা সংখ্যার গুণও সেকেন্ডের মধ্যে করে ফেলতে পারতেন এই গুণবতী নারী। ১৯৮২ সালে এই ক্ষমতার জোরে গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ নিজের নাম তুলেছিলেন শকুন্তলা দেবী। ১৯৮০ সালের ১৮ জুন লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজে চলছিল তাঁর গাণিতিক দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষা। অঙ্ক না শিখেই নির্ভুল উত্তর যিনি দেন, বিশ্বের কাছে তো তাঁকে পরীক্ষায় বসতেই হবে, এমনটাই নিয়ম। কিন্তু সেবারও যুক্তিবাদীদের তাজ্জব বানিয়ে দিয়ে দুটি ১৩ সংখ্যাকে গুণ করে তার উত্তর দিয়েছিলেন শকুন্তলা দেবী।
সংখ্যা দুটি ছিল- ৭,৬৮৬,৩৬৯,৭৭৪,৮৭০ x ২,৪৬৫,০০৯,৭৪৫,৭৭৯
ঘড়ির কাঁটায় ২৮ সেকেন্ড হয়েছে সবে, শকুন্তলা উত্তর দিলেন ১৮,৯৪৭,৬৬৮,১৭৭,৯৯৫,৪২৬,৭৭৩,৭৩০
হতবাক বিশ্ব!!! এমনটাও হয়!
তবে কেবল যোগ, গুণ, ভাগ নয়, শকুন্তলা সমানভাবে সাবলীল ছিলেন ক্যালেন্ডার ক্যালকুলেশনেও। সেটিরও পরীক্ষা হয়েছে। গত শতকের যে কোনও একটি তারিখ তাঁকে বলা হলেই তিনি বলে দিতেন সেই তারিখে কী বার ছিল। যেমন ধরা যাক, যদি তাঁকে বলা হত ১৯২০ সালের ৩১ জুলাই কোন বার ছিল? সপ্রতিভ উত্তর আসত- 'শনিবার'। গবেষকরা মিলিয়ে দেখেছেন একদম ঠিক। আর এই উত্তর দিতে সময় লাগত এক সেকেন্ড। মাত্র এক সেকেন্ড। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেছিলেন, "শকুন্তলার উত্তর স্টপওয়াচ চালুর আগেই এসে যেত।"
কোথায় শিখলেন এই অঙ্কের স্কিল? কতটা প্র্যাকটিস করতেন তিনি?
অঙ্ক, অঙ্কের জটিল হিসেব-নিকেশ, পাজলস নিয়ে প্রায় কয়েক ডজন বই লিখেছেন শকুন্তলা দেবী। বইতে দেখা যাচ্ছে, অঙ্কের যে নিয়ম শেখান হয়ে থাকে সচারচর, সেই ক্ষেত্রটি তাঁর নখদর্পণে। তা সে ত্রিকোণমিতি হোক কিংবা লগারিদমের হিসেব। কিন্তু বিস্ময় জাগে সেখানেই, কারণ কোনও প্রথাগত শিক্ষা নেই শকুন্তলা দেবীর। ছোটবেলা কেটেছে দরিদ্র পরিবারে। পরবর্তীতে যা আয়ত্ত করেছিলেন তা নিজে নিজে লেখাপড়া করে।
তাহলে কীভাবে সম্ভব এই গণিত গণনা? মস্তিষ্কের কোনও বিশেষ অংশ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছি কি?
শকুন্তলা দেবীর 'বিস্ময় প্রতিভা' নিয়ে কাজ করেছিলেন মনস্তত্ববিদ জেনসন। গণিতজ্ঞকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যা পেয়েছিলেন ১৯৯০ সালে জার্নাল ইন্টেলিজেন্সে তা প্রকাশ করেন তিনি। সেই প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শকুন্তলা দেবীর এই বিস্ময়কর ক্ষমতাকে বিশ্লেষণ করতে পারেননি তিনি। জেনসেন এই ক্ষমতাকে "অদ্ভুত ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে বিরল, সম্ভবত কয়েক কোটিতে একটি" হিসেবেই বর্ণনা করেছেন।
শারীরবিদ্যা বলে, আমাদের মস্তিষ্কের প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্সে অঙ্কের বিশ্লেষণ চলে। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, শকুন্তলা দেবীর ক্ষেত্রে সেই প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্স আর পাঁচজন সাধারণের মতোই। তবে? মনস্তাত্বিক জেনসনের মত, প্রথাগত শিক্ষার বেড়া ভেঙে সম্পূর্ণ নিজের নিয়মেই অঙ্ক সমাধান করতেন শকুন্তলা। আর সেই ব্যতিক্রমী গাণিতিক পথের সন্ধান মেলেনি আজও।
Read the full story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন