Sheikh Mujibur Rahman and Sheikh Hasina: অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই ফিরল ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট নিজের বাসভবনে সপরিবার খুন হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ৫০ বছরের মাথায় ৫ আগস্ট, দেশ ছাড়তে হল বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে।
মুজিবের শাহাদাতের মাসেই ইস্তফা
বাংলাদেশ 'স্বাধীন দেশ' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭১ সালে। তার কয়েকদিন আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রমনায় এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন মুজিবুর রহমান। রেসকোর্স ময়দানে সেই ভাষণে মুজিবুর রহমান বলেন, 'আমাদের আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।' কিন্তু, মুজিবের বিরোধী 'রাজাকার', জামাতরাও কোনওসময় চুপ থাকেননি। তাঁরা মুজিবের মেয়ে হাসিনাকে ছাড়লেন না। ছাত্র আন্দোলনকে সামনে রেখে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন মুজিবের শাহাদাতের মাস আগস্টেই। ছাত্রবিক্ষোভ এবং হিংসা ছড়িয়ে পড়ার মাত্র তিন দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হাসিনাকে ইস্তফা দিতে হল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'-এর নাম দিয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই থেকে বাংলাদেশে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। আন্দোলনকারীরা প্রথমে নয় দফা দাবি তোলে। তারপর সেখান থেকে সরে এলে একদফা দাবি জানায়। সেই দাবিতে হাসিনা সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন আন্দোলনকারীরা। শুধু ডাক দেওয়াই নয়। আন্দোলনকারীরা দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দেয়। এরপর আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। শাসক দল আওয়ামি লিগ এবং নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে শুধুমাত্র রবিবারই অন্ততপক্ষে ৯৮ জন প্রাণ হারান। এই হতদের মধ্যে ছিলেন ১৪ পুলিশকর্মী।
আওয়ামি লিগের অভিযোগ
আওয়ামি লিগ, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম পর্বে আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের 'রাজাকার' বলে কটাক্ষ করেছিল। হাসিনা পরে সেই অবস্থান থেকে সরে আন্দোলনের নেপথ্যে বিএনপি, কট্টরপন্থী সংগঠন জামাতের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। ছাত্রদের প্রতিবাদ থেকে কীভাবে পুলিশের ওপর যথেচ্ছ গুলি-বন্দুক প্রয়োগ হতে পারে, তা নিয়ে হাসিনা প্রশ্ন তোলেন। পালটা আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, 'আওয়ামি লিগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লিগ, আন্দোলনরত পড়ুয়াদের থামাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে।'
গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় হাসিনা
গত জানুয়ারি মাসে পঞ্চমবারের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেছিলেন শেখ হাসিনা। এই ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছিল প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং বাম দলগুলো। তাদের দাবি ছিল, 'নির্দল এবং নিরপেক্ষ' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন। কিন্তু, তেমন কোনও দাবি শেখ হাসিনার সরকার পূরণ করেনি। যার ফলে, কার্যত বিরোধীহীন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু, নির্বাচনে সেই নিরঙ্কুশ জয় পাওয়ার সাত মাস পরেই প্রধানমন্ত্রীর গদি শেখ হাসিনাকে ছাড়তে হল। তিনি গণ আন্দোলনের নামে জামাত-বিএনপির এই উচ্ছৃঙ্খলতাকে 'দাবায়ে' রাখতে পারলেন না।
আরও পড়ুন- কেন বাংলাদেশের রাস্তায় বিক্ষোভ ফিরল, এটা কি হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র?
সেনার কপ্টারে দেশ ছেড়েছেন
মুজিবের 'শাহাদাত'-এর প্রায় ৩০ বছরের কাছাকাছি সময়ে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট, শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। তিনি অল্পের জন্য সেই হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এবারের অগাস্টে তিনি প্রাণে বাঁচলেও নিজের গদি বাঁচাতে পারলেন না। তড়িঘড়ি ঘনিষ্ঠদের নিয়ে সেনার কপ্টারে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন।
একনজরে শেখ হাসিনা
বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রধান ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্ম শেখ হাসিনার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় দেশের বাইরে ছিলেন শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন রেহানা। পরিবারের বাকিরা নিহত হলেও সেই যাত্রায় বাইরে থাকায় বেঁচে যান দুই বোন। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামি লিগ সভাপতি হাসিনা টানা চতুর্থবারের জন্য এ বছরের ১১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদে নির্বাচনের পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। সেবারও জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে একতরফাভাবে দশম সংসদ নির্বাচনের অভিযোগ ওঠে। তাতে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। সেখানেও জয়ী হন হাসিনা। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক হয়। এই নির্বাচনে আগের রাতেই ব্যালটে ছাপ মারার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। ওই নির্বাচন 'রাতের ভোট' নামে পরিচিতি পায়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনা ফের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। এই বিতর্কিত নির্বাচনেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। নিজের দলের নেতাদেরকেই নির্দল প্রার্থী করে 'ডামি' প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন করা হয়েছিল। এই নির্বাচনকে বিরোধীরা 'ডামি নির্বাচন' বলে অভিযোগ করেন। হাসিনা মোট আটবার বাংলাদেশের সাংসদ হন।
১৯৮১ সাল থেকে হাসিনা আওয়ামি লিগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯১-১৯৯৫ পর্যন্ত তিনি বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ফের প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে একটি বিরোধীদলহীন নির্বাচনে তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১৮ সাল এবং তারপর ২০২৪ সালে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পঞ্চম মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্ষমতাশালী নারী হিসেবে ফোর্বসের তালিকায় ১০০ নারীর মধ্যে ২০২০ সালে হাসিনা ছিলেন ৩৯তম স্থানে। ২০১৯ সালে তিনি ছিলেন ২৯তম স্থানে। ২০১৮ সালে ছিলেন ২৬তম স্থানে। ২০১৭ সালে ছিলেন ৩০ তম স্থানে।
গত মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পরিস্থিতি। পরে সাময়িকভাবে অবস্থা আয়ত্তে আসলেও ফের হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বাংলাদেশের রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিহত হন কমপক্ষে ৩০০-র বেশি মানুষ। এরপর প্রবল অরাজক পরিস্থিতিতে সোমবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বোন রেহানা ও অন্য ঘনিষ্ঠরা।