/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/04/PP-23-SRILANKA-07.jpg)
শ্রীলঙ্কায় বিস্ফোরণে নিহতদের স্মৃতিতে কলকাতায় শ্রদ্ধার্ঘ। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
ইস্টারের দিন শ্রীলঙ্কায় সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী হামলা চালানোর সন্দেহ যাদের ওপর গিয়ে পড়েছে, সেই ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত বা এনটিজে কারা?
এনটিজে সম্বন্ধে এখনো খুব বেশি জানা যায় নি, কিন্তু ২০১৭ সাল থেকেই পুলিশের নজরে রয়েছে তারা। উল্লেখ্য, সেবছরই নিজেদের মুসলিম বিরোধী অভিযান আরও সক্রিয় করে তোলে বৌদ্ধ মৌলবাদী সংগঠন বোদু বালা সেনা - যারা গঠিত হয় ২০১২ সালে, কিন্তু যাদের গতিবিধি ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপতি মহিন্দা রাজাপক্ষের নির্বাচনী পরাজয়ের পর কিছুটা থিতিয়ে যায়। মনে করা হচ্ছে যে এনটিজে একটি অতিমাত্রায় উগ্রপন্থী সংগঠন, যা শ্রীলঙ্কা তৌহিদ জামাত ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর মধ্য শ্রীলঙ্কার কেগাল্লে জেলার মাওয়ানেল্লায় মোটরবাইকে আসীন কিছু দুুুুষ্কৃতী হাতুড়ি এবং অন্যান্য হাতিয়ার ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর করে। দুুষ্কৃতীদের শাস্তির প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংঘে, এবং পুলিশ এনটিজে-কে মূল সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেফতার করে।
আরও দুই সন্দেহভাজনের খোঁজে পুলিশ দৈবাৎ আবিষ্কার করে রাজধানী কলম্বোর উত্তরে পুত্তালাম জেলার ওয়ানাথাউইলুয়ায় ৮০ একরের এক নারকেল বাগানে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক এবং ডিটোনেটর। খুঁড়ে বের করা হয় প্রায় ৭৫ কিলো অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এবং পটাশিয়াম ক্লোরেট, সঙ্গে ছ'টি ২০ লিটারের নাইট্রিক অ্যাসিডের ক্যান, জানিয়েছে শ্রীলঙ্কার 'সানডে টাইমস'। একইসঙ্গে ওই বাগানের মধ্যেই একটি গুদামঘরে মেলে একটি শটগান, একটি এয়ার রাইফেল, দুটি তাঁবু, কিছু ধর্মীয় প্রকাশনা, এবং শুকনো খাবার। পুলিশের ভাষায় "স্থানীয় উগ্রপন্থী মুসলিম সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত" চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কায় গণহত্যা: কেন ভারতের সতর্কবার্তায় গুরুত্ব দেওয়া হল না?
তবে এসব কোনো কিছুর থেকেই আঁচ করা যায় নি, কতটা পরিশীলিত এবং বিধ্বংসী হতে যাচ্ছে ইস্টারের দিনের হামলা। এর আগে শ্রীলঙ্কায় লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম (এলটিটিই) তাদের সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে ব্যাঙ্ক ডাকাতি দিয়ে, এবং হাত পাকায় টার্গেট শুটিংয়ের মাধ্যমে। তাদের সন্ত্রাসের উন্নততম সোপান ছিল মানববোমা, যা সন্ত্রাসের জগতে তাদের একান্ত নিজস্ব অবদান। কিন্তু এনটিজে যদি সত্যিই রবিবারের হামলার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে বুঝতে হবে, মোটরবাইকে চড়া খুচরো দুষ্কৃতী থেকে এক ধাক্কায় উচ্চ পর্যায়ের ফিদায়ীন হামলাকারীতে পরিণত হয়েছে তারা। অবাক হওয়ার মতোই কথা বটে, যদিও ক্যাবিনেট মন্ত্রী রজিতা সেনারত্নের মতে, "আন্তর্জাতিক" কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সাহায্য পেয়েছে এনটিজে।
'তৌহিদ' শব্দটির অর্থ ঈশ্বরের একত্ব, যা ইসলাম ধর্মের মূল বিশ্বাস। এ বিষয়ে যে কোনো তৌহিদ গোষ্ঠীর আদর্শগত মিল রয়েছে আইসিস-এর সঙ্গে, যার জন্মদাতা সংগঠন জামাত আল-তৌহিদ ওয়াল-জেহাদ পরে আল-কায়েদায় যোগ দেয়। ২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কার সরকার সে দেশের সংসদে জানায়, বিত্তবান পরিবার থেকে আসা মোট ৩২ জন যুবক আইসিসে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছেন। সম্প্রতি সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে, যদিও নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা জানা যায় নি।
তবে কি শ্রীলঙ্কায় এমন কোনো ইসলামি জেহাদের সমস্যা রয়েছে যা এযাবতকাল বোঝা যায় নি? দেশে কি বৃহত্তর বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘাত রয়েছে?
শ্রীলঙ্কার ২১ মিলিয়ন জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও কম মুসলিম ধর্মাবলম্বী। ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা নিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জায়গায় আছেন সিনহালা-বৌদ্ধরা। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ভাগ সাত শতাংশ, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন তামিল এবং সিনহালিজ দুইই। হিন্দুদের ভাগ ১২.৬ শতাংশ, এবং তাঁরা প্রায় পুরোপুরিই তামিলভাষী। এর আগে যদিও শ্রীলঙ্কায় কোনো জেহাদি গোষ্ঠীর উদাহরণ পাওয়া যায় নি, বা সেদেশের কোনো নাগরিকের বসনিয়া বা আফগানিস্তানে যুদ্ধে যোগ দিতে যাওয়ার খবর পাওয়া যায় নি, নব্বইয়ের দশকে একাধিকবার দেশে ওয়াহাবি সংস্কৃতির প্রসার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, বিশেষ করে পূর্ব শ্রীলঙ্কার বাত্তিকালোয়া এবং আমপারা জেলায়, যেখানে বেশি সংখ্যক মুসলিমদের বাস। ত্রিনকোমালি সহ সমগ্র পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মুসলিম।
শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা তামিল ভাষায় কথা বলেন, এবং একসময় রাজনৈতিক ভাবে এলটিটিই-র সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করলেও সম্পর্কে চিড় ধরে ১৯৯০ সালে, যার মূলে ছিল এলটিটিই-র সন্দেহ যে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় মোতায়েন ভারতীয় শান্তিরক্ষা বাহিনীর হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন মুসলিমরা, এবং পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর হয়েও একই কাজ করছিলেন তাঁরা। রাতারাতি জাফনা থেকে আন্দাজ ৯০ হাজার মুসলিম নাগরিককে উৎখাত করে এলটিটিই। অনেকেই আশ্রয় নেন পুত্তালাম জেলার শরণার্থী শিবিরে, এবং অনেকেই সেখানেই রয়েছেন আজও।
আরও পড়ুন: সাধ্বী প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ
নব্বইয়ের দশক জুড়ে শ্রীলঙ্কা মুসলিম কংগ্রেসের (এসএলএমসি) মধ্যে একটি পৃথক 'মুসলিম' রাজনৈতিক চেতনা গড়ে ওঠে। এসএলএমসি দাবি জানায়, উত্তর পূর্বাঞ্চলের তামিল অধ্যুষিত এলাকার অন্তর্গত কিছু মুসলিম ছিটমহলের, কিন্তু ওই এলাকায় রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনে আগ্রহী তামিল রাজনীতিকরা এই দাবি সমর্থন করেন নি। উল্টে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাত্তিকালোয়ার কাট্টানকুড়িতে দুটি মসজিদ আক্রমণ করে এলটিটিই, যাতে প্রাণ হারান কয়েকশো মানুষ।
তার কিছুদিনের মধ্যেই এলাকায় তৈরি হয় নতুন মসজিদ, যার খরচ নাকি বহন করে সৌদি আরব। দেশের পূর্বাঞ্চলে মুসলিমরা যে তামিল বলতেন, তার মধ্যে ঢুকে পড়ে কিছু আরবি শব্দ।
তা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা তৌহিদ জামাত বা এনটিজে জাতীয় সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না কয়েক বছর আগে পর্যন্তও। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, এই সংগঠনগুলির উঠে আসার সঙ্গে সরাসরি যোগ রয়েছে যুদ্ধ-পরবর্তী শ্রীলঙ্কার যুদ্ধজয়ের উল্লাসের আবহে বৌদ্ধ মৌলবাদের উত্থানের। যুদ্ধের পর কিছু অমীমাংসিত সমস্যার জেরে তীব্রতর হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ চেতনা। মনে হচ্ছিল যেন এলটিটিই-র পরাজয়ে পর্যুদস্ত তামিলদের বিকল্প কোনও "শত্রুর" খোঁজে রয়েছেন বৌদ্ধ চরমপন্থীরা। সম্ভবত এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই ২০১৩ থেকে প্রতি বছর অন্তত একটি গুরুতর মুসলিম-বিরোধী ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের মার্চ মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব রটার ফলে ব্যাপক হিংসা ছড়ায়। এতটাই, যে যুদ্ধের পর প্রথমবার ফের জরুরি অবস্থা জারি হয় শ্রীলঙ্কায়।
সমস্যা যদি হয় বৌদ্ধ এবং মুসলিমদের মধ্যে, তবে খ্রিস্টানদের নিশানা করা হলো কেন? কী বার্তা দেওয়া হলো, এবং কাকে?
এখানেই হোঁচট খাচ্ছে রবিবারের ঘটনায় স্থানীয় অভিসন্ধির খোঁজ। বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘাতের ফলে তোপের মুখে খ্রিস্টানরা, যাঁরা সংখ্যায় মুসলিমদের চেয়ে অনেক কম - এই হিসেবটা একেবারেই মিলছে না। ইস্টারের দিন চার্চের উপর হামলা বরং আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করার উৎকৃষ্ট উপায়, যেমন উচ্চশ্রেণীর আন্তর্জাতিক পর্যটক, কূটনীতিক, বিভিন্ন উচ্চপদস্থ পেশাদার, এবং বিত্তশালী স্থানীয়দের ডেরা পাঁচতারা হোটেলকে নিশানায় রেখে লাভ। হামলার সময় প্রত্যেকটি হোটেলে প্রথা মেনেই চলছিল জনপ্রিয় 'ইস্টার ব্রাঞ্চ'।
শ্রীলঙ্কায় ইসলামি মৌলবাদের সঙ্গে ভারত মহাসাগরের অন্যান্য অঞ্চলের, বিশেষ করে মালদ্বীপের, মৌলবাদের কোনও মিল রয়েছে?
ইসলামি মৌলবাদের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার চেয়ে আরও অনেক বেশি চিন্তার কারণ হলো মালদ্বীপ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর-শেষের হিসেব অনুযায়ী, সেদেশের ২০০-র বেশি তরুণ-তরুণী আইসিসে যোগ দিয়েছিলেন। বর্তমান পরিসংখ্যান জানা যায় না, কিন্তু ওই সংখ্যা যে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নিশ্চিত। যেখানে মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যাই স্রেফ সাড়ে চার লক্ষ, সেখানে এই সংখ্যা অবহেলা করার মতো নয়। অবশ্য দেশের ভূতপূর্ব একনায়ক মামুন আব্দুল কায়ুমের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা মৌলবাদী শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের খেলাঘর এই দ্বীপপুঞ্জ।
ভারত মহাসাগর অঞ্চলে জেহাদি কার্যকলাপের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার ঘটনা থেকে কী কী শিক্ষা নিতে পারে ভারত?
আমাদের 'নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান'-এর দেশে যে ইসলামি মৌলবাদ খুব গভীর শিকড় গেড়ে বসতে পারবে না, সে ব্যাপারে বরাবরই প্রত্যয়ী থেকেছে ভারত। সারা দেশ থেকে ১০০ জনও আইসিসে যোগ দেন নি। কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি জারি করেছেন যে, আগ্রাসী হিন্দুত্বের উত্থান, মুসলিমদের উপর আক্রমণ, এবং রাজনৈতিক ভাবে ভারতের মুসলিমদের কোণঠাসা করার নীতির ফলে কিছু আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা দেওয়া আশ্চর্য নয়।
কৌশলগতভাবে, ভারত মহাসাগরে শ্রীলঙ্কার মতো মিত্র রাষ্ট্রের অস্থিতিশীল অবস্থা চাইবে না ভারত, যদিও এই মিত্রতায় ইদানীং কালে বাদ সেধেছে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বার্থ।
শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে কি রবিবারের হামলার কোনও যোগ রয়েছে?
প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংঘে বলেছেন, দেশে সন্ত্রাসী হামলার "আগাম খবর" ছিল, কিন্তু তাঁকে জানানো হয় নি। প্রশাসনের উচ্চতম স্তরে, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি মৈত্রীপাল শিরিসেনার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই যে ভারতের কাছ থেকে আগাম খবর পাওয়া সত্ত্বেও কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেয় নি শ্রীলঙ্কা, তা এখন স্পষ্ট। শ্রীলঙ্কা পুলিশের তরফে অবশ্য রাষ্ট্রীয় সতর্কতা জারি করা হয়, যাতে বলা হয় যে ভারতীয় হাইকমিশন এবং দেশের বিভিন্ন গির্জার উপর হামলার সম্ভাবনা রয়েছে।