রবিবার শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে ২০০ জন মারা গেছেন। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকারের তদন্তে এই আক্রমণের পিছনে একটি জিহাদি সংগঠনের হাত থাকার সম্ভাবনার কথাই উঠে আসছে। যে আট জায়গায় বিস্ফোরণ হয়েছে, তার অন্যতম সিনামন গ্র্যান্ড হোটেল থেকে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতের পরিবার ৬ মাস আগে তার নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়েছিল।
আটটি বিস্ফোরণের মধ্যে শেষ দুটি বিস্ফোরণ ঘটেছে যখন নিরাপত্তাকর্মীরা সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করার ঠিক আগে। পুলিশ অবশ্য কোনও জিহাদি গোষ্ঠীর নামোল্লেখ করেনি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস একটি ভারতীয় ও একটি শ্রীলঙ্কা সূত্র থেকে জানতে পেরেছে, এ মাসের গোড়ার দিকে ভারত শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষকে জঙ্গি হামলার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে সাবধান করেছিল।
মনে করা হচ্ছে ভারতের কাছ থেকে সতর্কবার্তা পাওয়ার পর শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধান ১১ এপ্রিল ভারতীয় দূতাবাস এবং দেশের গির্জাগুলিতে হামলার সম্ভাবনা জানিয়ে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন। ওই সতর্কবার্তায় ন্যাশনাল তৌহিত জামাত নামের একটি সংগঠনের নামোল্লেখ করা হয়েছিল। এই সংগঠনটি গোঁড়া ইসলামের প্রচারক।
তা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা বাহিনী এ ব্যাপারে তত উদ্যোগী হয়নি। গোটা দেশে গত ১২ এপ্রিল থেকে শ্রীলঙ্কা-তামিল নববর্ষ, গুড ফ্রাইডে এবং ইস্টার উপলক্ষে প্রায় সবই বন্ধ। গত এক দশকে শান্তির বাতাবরণে শ্রীলঙ্কা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে সতর্কবার্তা পাঠানো সত্ত্বেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কতটা প্রয়োজন।
২০০৯ সালে এলটিটিই-কে পরাজিত করার পর এই প্রথম এত সংগঠিত হামলার মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। এ দেশে এরকম সন্ত্রাসবাদী হামলা আগে কখনও হয়নি।
নিঃসন্দেহে তামিল টাইগাররা ছিল নৃশংস। কলম্বোর সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে ১৯৯৬ সালের আত্মঘাতী গাড়ি হামলায় ৯১ জন নিহত হন। এছাড়া পুলিশ ও সেনা ছাউনিতে তাদের বারংবারের হামলায় শয়ে শয়ে মানুষ হতাহত হয়েছেন। ৯-১১-র মাত্র দু মাস আগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে টাইগার হামলায় শ্রীলঙ্কার প্রায় সমস্ত বিমান ধ্বংস হয়ে যায়।
কিন্তু রবিবারের বোমা হামলা এর কোনওটার সঙ্গেই তুলনীয় নয়। ২০০৯ সালের মে মাসে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরবর্তী কাল থেকে এলটিটিই এখন তামিল ভাষাভাষী মানুষের একাংশের কল্পনা ছাড়া অন্য কোথাওই নেই। মান্নারের মাধু গির্জায় হামলার ঘটনা ছাড়া টাইগাররা কোনও সময়েই ক্যাথলিক গির্জার ওপর আক্রমণ চালায় নি, ক্যাথলিকরাও তামিলদের ইস্যুতে তাদের সমর্থনই জুগিয়েছে। উত্তরপূর্বের বহু তামিলই এলটিটিই অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দুদের সঙ্গে শান্তিতেই বসবাস করেছেন। বরং, ১৯৯০ এ উত্তর পূর্বে মুসলিমরা টাইগারদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন, ঘরছাড়াও হয়েছেন।
রবিবার দুটি ক্ষেত্রে আত্মঘাতী হামলা ঘটেছে, যা জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। কিন্তু হামলার লক্ষ্যবস্তুর দিক থেকে দেখলে, এ ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১৮ সালের এক রবিবারের সকালে ঘটা দক্ষিণ ফিলিপিন্সে মিনদানাও-তে দুটি গির্জায় বিস্ফোরণের কথা, যে ঘটনায় পূর্ব এশিয়ার আইসিসের সঙ্গে যোগসাজশের কথা জানা গিয়েছিল। একই সঙ্গে এ বিস্ফোরণ মনে করিয়ে দিচ্ছে নিউজিল্যান্ডে শ্বেতাঙ্গ হামলার কথা।
মৃতের সংখ্যার দিক থেকে হিসেব করলে, বিদেশি পর্যটকে ভরপুর উঁচু মানের হোটেলে হামলা করার ঘটনা মনে পড়িয়ে দেয় ২০০৮ সালের মুম্বই হামলার কথা, যে ঘটনায় ১৬৬ জন মারা গিয়েছিলেন।
ইস্টারের হামলার ঘটনার সঙ্গে মিল রয়েছে ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ লাহোরে গুলশন-এ-ইকবাল পার্ক হামলার কথা, যে ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ৭৫ জন। ২০১৭ সালের পাম সানডে-তে ইজিপ্টে দুটি গির্জায় হামলার ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ৪৫ জন।
গির্জা সহ খ্রিষ্টান কেন্দ্রে হামলার পৃথিবী জোড়া যে ঘটনাসমূহ, তার দায় স্বীকার করেছে আইসিস, তার সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলিই।
গত ১১ এপ্রিল পুলিশি সতর্কবার্তায় ন্যাশনাল তৌহিত জামাতের নাম উঠে এসেছে। গত বছর আইসিসে যোগ দেওয়ার জন্য যে শতাধিক শ্রীলঙ্কাবাসী দেশ ছেড়েছিল, তাদের উপর এই সংগঠনের প্রভাব রয়েছে।
ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কার তৌহিত জামাত তাদের ফেসবুক পেজে এ ঘটনার নিন্দা করে অপরাধীদের চরম শাস্তির দাবি তুলেছে। রবিবার তারা ক্যান্ডিতে রক্তদান শিবির খোলে, এবং সে ঘটনার ছবি ফেসবুক পেজে দিয়ে তারা বলে, এই চরম সময়ে তারা সাধ্যানুযায়ী জাতির পাশে থাকতে চায়।
গত পাঁচ বছরে শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ মৌলবাদীদের ইন্ধনে মুসলিমদের সঙ্গে তাদের দাঙ্গা বেঁধেছে। ২০১১ সালের জনগণনায় সে দেশে মুসলিমদের সংখ্যা ১০ শতাংশেরও নিচে, হিন্দুদের সংখ্যা ১২.৬ শতাংশ, খ্রিষ্টানরা ৭ শতাংশের একটু বেশি। মোট ২১ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই বৌদ্ধ।