Advertisment

Explained: মমতা-ন্যানোর কাহিনি: কেন রাজ্যের থেকে টাটা ৭৬৬ কোটি টাকা, সুদের দাবিদার?

সরকার 'সিঙ্গুর ল্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিল, ২০১১' পাস করিয়েছিল।

IE Bangla Web Desk এবং Chinmoy Bhattacharjee
New Update
Mamata Singur

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০৮ সালে সিঙ্গুরে একটি সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছেন। (এক্সপ্রেস ফাইল ছবি)

টাটা মোটরস লিমিটেড সোমবার (৩০ অক্টোবর) একটি বিজ্ঞপ্তিতে স্টক এক্সচেঞ্জগুলিকে জানিয়েছে যে সালিশি ট্রাইব্যুনাল তাদের কোম্পানিকে, '৭৬৫.৭৮ কোটি টাকা দিতে বলেছে। প্রকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিবছর ১১ শতাংশ হারে সুদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।' এই অর্থ সিঙ্গুরে উৎপাদন কেন্দ্রে মূলধন বিনিয়োগের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে আদায় করা হবে। সিঙ্গুরে টাটা তার ছোট গাড়ি ন্যানো তৈরির জন্য একটি কারখানা তৈরি করেছিল। সেই সময়ে টিএমসির প্রতিবাদের মুখে টাটারা চলে যেতে বাধ্য হয়।

Advertisment

সিঙ্গুর এবং টাটাদের ন্যানো গাড়ির গল্প

বামফ্রন্ট ২০০৬ সালে বাংলায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। শিল্পায়ন এবং চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়। সেই বছর মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন যে টাটাকে ন্যানো তৈরির কারখানা বানানোর জন্য প্রায় ১,০০০ একর জমি দেওয়া হবে। হুগলি জেলার সিঙ্গুরে চিহ্নিত জমির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রচেষ্টা অবশ্য সমস্যায় পড়েছিল। স্থানীয় লোকজনের একটি দল এবং SUCI(C) এবং CPI(ML) এর মত ছোট দল 'উর্বর' ফসলি জমি দখল করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। যাইহোক, অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়, এবং ন্যানো কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষ

২০০৭ সালে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং টিএমসি ক্যাডাররা সিঙ্গুরের মূল শিল্প এলাকায় পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এরপর মমতা ২৬ দিনের অনশন শুরু করেন। যা, বিশিষ্ট পরিবেশ কর্মীদের সমর্থন লাভ করে। ২০০৮ সালে জানুয়ারিতে, টাটা মোটরস নতুন দিল্লি অটো এক্সপোয় ন্যানো বাজারে আনার কথা ঘোষণা করে। এরপরই কলকাতা হাইকোর্ট কোম্পানিকে জমি বরাদ্দ বহাল রাখে। পালটা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এই আন্দোলন, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জেরে গতি অর্জন করে।

গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর মধ্যস্থতা

তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস এবং সরকারের মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করে সফল হননি। পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। অচলাবস্থার মধ্যে, টাটা মোটরস পশ্চিমবঙ্গ থেকে ন্যানো উৎপাদন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর, সেই কথা জানিয়েও দেয়। গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সময় টাটাদের ডেকে আহমেদাবাদ জেলার সানন্দে ন্যানো কারখানার জমি দেন।

হাইকোর্টে লড়াই

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলায় ক্ষমতায় আসেন। বামদের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটান। তাঁর প্রথম মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছিল ৪০০ একর জমি 'অনিচ্ছুক কৃষকদের' ফেরত দেওয়া হবে। সরকার এর প্রেক্ষিতে 'সিঙ্গুর ল্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিল, ২০১১' পাস করে। রাজ্য সরকার ২০১১ সালের জুনে জমিটি দখল করার পরে, টাটা মোটরস কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। কলকাতা হাইকোর্ট বিষয়টি নিয়ে হস্তক্ষেপ না-করায় টাটা মোটরস এরপর সুপ্রিম কোর্টে যায়।

সুপ্রিম কোর্টে লড়াই

শীর্ষ আদালত হাইকোর্টকে বিষয়টি সমাধান করতে বলেছিল এবং সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টের একক বিচারপতির বেঞ্চ সরকারের পক্ষে রায় দেয়। টাটা মোটরস আপিল করে, এবং হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০১১ সালের আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই সিদ্ধান্তকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে। ২০১৬ সালের ৩১ অগাস্ট সুপ্রিম কোর্টে, বিচারপতি ভি গোপাল গৌড়া ও বিচারপতি অরুণ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গুরে বামফ্রন্ট সরকারের ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ বাতিল করে দেয়। একইসঙ্গে আদালত নির্দেশ দেয় যে জমিটি ১২ সপ্তাহের মধ্যে তার মালিকদের কাছে ফেরত দেওয়া উচিত। এই রায়ের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'আমি এখন শান্তিতেও মরতে পারি'। আদালতে এই জয়কে তিনি সিঙ্গুর আন্দোলনের 'শহিদদের ঐতিহাসিক বিজয়' বলে তাঁদের প্রতি উৎসর্গ করেছিলেন।

আরও পড়ুন- সিঙ্গুরে টাটাকে ক্ষতিপূরণ! এরপরও শিল্প সম্মেলন থেকে বিরাট আশা মমতা সরকারের

সালিশির রায়

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর টাটা মোটরস, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেডের (ডব্লিউবিআইডিসি) কাছে সালিশির জন্য গিয়েছিল। এর কারণ হল, 'মূলধন বিনিয়োগের ক্ষতি'র কারণে হওয়া ক্ষতিপূরণ দাবি। যে বিনিয়োগের পরও ২০০৮ সালে কোম্পানি উৎপাদন শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছিল। স্টক এক্সচেঞ্জে তার বিজ্ঞপ্তিতে টাটা মোটরস বলেছে যে, 'তিন সদস্যের সালিশি ট্রাইব্যুনালের সামনে মুলতুবি থাকা সালিশি কার্যকলাপের নিষ্পত্তি অবশেষে ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর টাটা মোটরস লিমিটেডের পক্ষে হয়েছে। যার জেরে টাটা মোটরস ৭৬৫.৭৮ কোটি টাকা এবং অর্থ পুনরুদ্ধার না-হওয়া পর্যন্ত ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুদ হিসেবে ডব্লিউবিআইডিসির থেকে প্রতিবছর ১১% হারে সুদ পাবে। এছাড়াও, মামলার খরচের জন্য ১ কোটি টাকা পাবে।'

Singur Movement High Court Supreme Court of India
Advertisment